প্রতি ঘরেই জ্বরের প্রকোপ
যশোরে প্রতিদিন হাসপাতালে ছুটছেন কয়েকশ রোগী
প্রকৃতিতে এখন রোদ-বৃষ্টি, ঠাণ্ডা-গরমের প্রবণতা চলছে। প্রকৃতির এ বিরূপ আচরণে ঠাণ্ডা-গরম লেগে মৌসুমি জ্বর, ইনফ্লুয়েঞ্জা সর্দি-কাশি দেখা দিচ্ছে। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা এ মৌসুমি জ্বরে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। পাশাপাশি আছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব।
যশোরে এখন প্রায় প্রতি ঘরেই কেউ না কেউ জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিনই কয়েকশ মানুষ জ্বরের লক্ষণ নিয়ে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ছুটছেন। পাশাপাশি ক্লিনিক বা গ্রাম্য চিকিৎসকদের কাছ থেকেও চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। যদিও চিকিৎসকরা প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য ওষুধ সেবন নিষেধের পাশাপাশি জ্বর নিয়ে অবহেলা না করে দ্রুত তাদের পরামর্শ নিতে বলছেন।
যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর হাসপাতালে এখন প্রতিদিনই জ্বর, সর্দি, কাশি, গায়ে ব্যথা নিয়ে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। সোমবার (৭ আগস্ট) হাসপাতালের বর্হিবিভাগে মোট ১ হাজার ৬৩৬ জন চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। এর মধ্যে জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশির রোগী ১৯৫ জন। এছাড়া জ্বরে আক্রান্ত আটজন ভর্তি হয়েছেন। এখন প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালে এ চিত্র বিরাজ করছে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অনেক রোগী আসছেন জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। আর এ রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা-সর্দি-কাশি-জ্বর সাধারণত সাত দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। মৌসুমি ভাইরাস জ্বরের লক্ষণের মধ্যে আছে হঠাৎ জ্বর এসে ১০২-১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়, শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়, সঙ্গে প্রচুর মাথাব্যথা থাকে, অনেক সময় গলা ব্যথা থাকে এবং গায়ে, হাতে, পায়ে ও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মাংসপেশিতে অসহ্য ব্যথা হতে পারে ।
রোগীরা বলছেন, এবারের জ্বরের শরীর ব্যথা তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। শরীরে এমন ব্যথা হয় মনে হয় কেউ হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, শরীরের জয়েন্টগুলো মনে হচ্ছে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। বেশিরভাগ সময় শরীরে জ্বরের সঙ্গে সর্দি, কাশি থাকে।
যশোর সদর হাসপাতালে মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া সদর উপজেলার পুলেরহাট এলাকার বাসিন্দা রাজিব বিশ্বাস বলেন, কয়েকদিন ধরে শরীরে জ্বর দেখা দিয়েছে। এর আগে বাড়িতে আমার মেয়ে জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। তিনদিনেও জ্বর না কমায় আমি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।
হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আব্দুস সামাদ জাগো নিউজকে বলেন, শিশুদের জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুরো শরীর নরম কাপড়ে কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে মুছে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শে জ্বর ও ব্যথা কমার ওষুধ খেতে হবে। গরম-ঠাণ্ডার কারণে শিশুদের নাক বন্ধ থাকে। নাক দিয়ে পানি পড়ে। মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে খিদে কমে যায় ও বমি বমি ভাব থাকে। শিশুদের মুখ লাল হয়ে যায়। খেয়াল রাখতে হবে জ্বর কখনো বাড়তে দেওয়া যাবে না।
যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার হারুন অর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরের রোগীও প্রচুর আসছে। প্রতিদিন বর্হিবিভাগে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর দশ শতাংশ জ্বর নিয়ে আসে। তাদের যথাযথ চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন মতো ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরণের ওষুধ সেবন না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া যশোরে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকায় জ্বর নিয়ে রোগীরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন। হাসপাতালের বর্হিবিভাগ থেকে চিকিৎসা নেওয়া শহরের বেজপাড়া এলাকার আলী হোসেন লেন, ডেঙ্গুজ্বরে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে শুনে জ্বর নিয়ে বাড়ি বসে থাকিনি। হাসপাতালে ডাক্তার দেখিয়েছি। তবে ডেঙ্গুর লক্ষণ না থাকায় ডাক্তার ওষুধ নিয়ে বাড়ি বিশ্রামে থাকতে ও প্রচুর তরল খাবার খেতে বলেছেন।
মণিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তন্ময় বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, এখানে ঠাণ্ডা-জ্বরের রোগীর সংখ্যা অনেক। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগে প্রতিদিনই প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এদের মধ্যে ৫০-৬০ শতাংশ রোগীই জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশি নিয়ে আসছেন। যাদের অবস্থা জটিল, তাদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়। বাকিদের ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা ও বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা এবং তাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে।
অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বর্হিবিভাগে প্রতিদিনই ৬০০-৭০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। এর এক-তৃতীয়াংশই জ্বরের রোগী। এর মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের রোগীও থাকছে। প্রতিদিনই অর্ধশতাধিক রোগীর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দিয়ে ভর্তি অথবা বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
যশোর সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে, জেলায় এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৭১ জন। এর মধ্যে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ৩৯ জন, শার্শায় আটজন, মণিরামপুর ও কেশবপুরে ছয় জন করে, ঝিকরগাছায় পাঁচজন এবং চৌগাছায় তিনজন ভর্তি আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। সবমিলিয়ে যশোরে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪৯৫ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন তিনি জন।
যশোরের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নাজমুস সাদিক রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, যশোরে ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রবণতা থাকায় জ্বরের রোগীদের তৃতীয় দিনে এনএস-১ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর সাধারণ জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুধুমাত্র প্যারাসিটামল সেবন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ সেবন না করতে বলা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ পানি, তরল খাবার এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার কয়েকগুণ বেশি রোগী জ্বর নিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। জ্বরে আক্রান্ত শহরের শংকরপুর এলাকার সোনিয়া আফরিন জানালেন, প্রচণ্ড জ্বর ও গা-ব্যথা হওয়ায় পল্লী চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হয়েছেন। ওষুধ খাওয়া শুরুর পর জ্বর কমে যাওয়ায় আর হাসপাতালে যেতে হয়নি।
যশোর শহরের রেলগেট এলাকার কিয়াম ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী রাজু মল্লিক বলেন, প্রতিদিনই ১০-২০ জন জ্বরের রোগী আসছেন। তারা জ্বরের ওষুধ ও পরামর্শ নিচ্ছেন। জ্বর বেশিদিন হলে তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। জ্বরের রোগীর প্রেসক্রিপশন নিয়েও অনেক স্বজন ওষুধ নিয়ে যাচ্ছেন।
এসজে/এএসএম