সুযোগ থাকতেও উন্নয়নে পিছিয়ে দাকোপ-বটিয়াঘাটা
একদিকে নদীপথ অন্যদিকে সড়ক। পাশেই রয়েছে সমুদ্র বন্দর। একটি এলাকা শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে এর বেশি কিছু প্রয়োজন না হলেও ২-৩টি গ্যাস কোম্পানি আর কয়েকটি হ্যাচারির মধ্যেই সীমাবদ্ধ খুলনার দাকোপ-বটিয়াঘাটা (খুলনা-১ আসন) এলাকার উন্নয়ন। তবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ার পেছনে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উদাসিনতা আর দলীয় কোন্দলকে দায়ী করেছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী বলছেন, খুলনার একাধিক বড় বড় নদ-নদী পরিবেশষ্টিত এবং সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা দাকোপ ও বটিয়াঘাটা। পশুর নদ, শিবসা, পানখালী, কাতিয়ানাংলা, কাজীবাছা, শৈলমারীর মতো বড় নদী রয়েছে এই উপজেলা দু’টিতে। খুলনা শহরের সঙ্গেই সরাসরি সংযোগ সড়ক রয়েছে বটিয়াঘাটা উপজেলার। বটিয়াঘাটার সঙ্গে সড়ক ও নদীপথে যোগাযোগ রয়েছে দাকোপের। তরমুজের জন্য এরইমধ্যে সারাদেশে ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছে এই দুই উপজেলার।
এছাড়া সুন্দরবনের অভ্যন্তরে দাকোপ উপজেলার চালনা ছিল দেশের দ্বিতীয় সমুদ্র বন্দর। তবে নদ-নদীগুলোর নাব্য সংকটের কারণে চালনা বন্দর চলে যায় বাগেরহাটের মোংলায়। পশুর নদ এবং শিবসা নদীর সংযোগস্থলের এই উপজেলাকে ঘিরে উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও সেদিকে নজর দেয়নি কেউ। এমনকি সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার কথা বলা হলেও তাও হয়নি।
সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দাকোপে গড়ে উঠেছে কয়েকটি গ্যাস কোম্পানি, ২টি সিমেন্ট কারখানা আর কয়েকটি মৎস্য হ্যাচারি। যেখানে এলাকাবাসীর কর্মসংস্থান হয়েছে খুবই কম।
তবে বড় বড় নদ-নদী অন্যদিকে শহরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে এই এলাকাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে খুলনার এই আসনটি একবারই হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। ১৯৮৮ সালের সেই নির্বাচনে এখানে জয়লাভ করেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শেখ আবুল হোসেন। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে এই আসনে জয়লাভ করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য প্রার্থীরা।
১৯৭৩ সালে দলের প্রার্থী প্রফুল্ল কুমার মন্ডল, ১৯৭৯ সালে প্রফুল্ল কুমার শীল, ১৯৮৬ সালে শেখ হারুনুর রশীদ, ৯১’তে পুনরায় শেখ হারুনুর রশীদ। দলীয় কোন্দল ঠেকাতে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এখানে প্রার্থী হন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে তিনি আসনটি ছেড়ে দিলে আবারও মনোনয়ন পান শেখ হারুন। কিন্তু দলের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন দলের আরেক নেতা পঞ্চানন বিশ্বাস। মূলত সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই নেতার লড়াইয়ে পঞ্চানন বিশ্বাস জয়ী হন। ২০০১-এ পুনরায় পঞ্চানন বিশ্বাস, ২০০৮-এ পঞ্চাননকে বাদ দিয়ে ননী গোপাল মন্ডলকে মনোনয়ন দিলে তিনিও জয়লাভ করেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দু’বারই পঞ্চানন বিশ্বাস দলীয় প্রার্থী হয়ে জয়ী হন।
ধারাবাহিকভাবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করলেও গত ১৫ বছরে এলাকার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও সেই মান্ধাতা আমলের মতোই। বটিয়াঘাটা থেকে সড়ক পথে দাকোপ যেতে সবচেয়ে বড় বাধা পানখালী নদী। গত ১৫ বছরেও এই নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হননি স্থানীয় সংসদ সদস্যরা।
দাকোপের সুতরখালী এলাকার বাসিন্দা মো. আব্দুল লতিফ, কালাবগি এলাকার নিতাই রঞ্জন পোদ্দার, হরসিত মন্ডল ও দাকোপ সদরের বাসিন্দা গোলাম মোস্তফা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত ১৩-১৪ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। এর আগেও এই আসনের সংসদ সদস্যরা ছিলেন আওয়ামী লীগের। তারা পানখালী সেতু নির্মাণ করতে সক্ষম হননি। ভাঙাচোরা ফেরি দিয়ে চলছে যাতায়াত।
দাকোপের তরমুজচাষি অনিল পোদ্দার, কৃষ্ণপদ পোদ্দার বলেন, দাকোপ থেকে প্রতি বছর ৬-৭শো কোটি টাকার তরমুজ রপ্তানি হয়। কিন্তু পানখালী সেতু না হওয়ায় এবং বেহাল সড়কের কারণে তরমুজ পরিবহনে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। দিনের পর দিন ট্রাক লোড করে বসে থাকতে হয় শুধু ফেরির অপেক্ষায়। এতে করে অনেক লোকসান গুনতে হয় চাষিদের। সঠিক সময়ে পরিবহন করতে না পারায় ক্ষেতের তরমুজ ক্ষেতেই নষ্ট হয়।
বটিয়াঘাটা এলাকার বাসিন্দা খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ সম্পাদক শ্রীমন্ত রাহুল অধিকারী বলেন, একটি সভ্যতা গড়ে উঠতে নদীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারণ এখনো বিশ্বে রপ্তানি পণ্যের শতকরা ৮০ ভাগই হয়ে থাকে জলপথে। দাকোপ-বটিয়াঘাটায় সেই সুবিধা থাকলেও তা কোনো কাজে আসেনি। সড়ক যোগাযোগের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা থাকলেও তা কাজে লাগানো যায়নি। ফলে এলাকার উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা এলাকাবাসী বুঝতে পারছে। এছাড়া এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা নদীভাঙন। সেই বিষয়ে স্থায়ী কোনো পদক্ষেপ আজও চোখে পড়েনি।
তিনি আরও বলেন, বিগত সময়ে এলাকায় খুব বেশি উন্নয়ন হয়নি। যা কিছু উন্নয়ন হয়েছে তা এলাকাকেন্দ্রীক। কর্মসংস্থানের জন্য কলকারখানার প্রয়োজন। সব সুবিধা থাকতেও তা হয়নি। দাকোপ উপজেলার কালীনগরে যে সেতু (কামারখোলা-সুতরখালী) হয়েছে তা শুধুমাত্র এই দুই ইউনিয়নবাসীর জন্য। সামগ্রীকভাবে এই সেতু উপজেলার তেমন কাজে আসে না। ১৪ বছরেও এই সেতুর সংযোগ সড়ক করা হয়নি।
তিনি বলেন, শুধু যোগাযোগ ব্যবস্থা নয়, দাকোপ-বটিয়াঘাটায় নেই সুপেয় পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। দুর্গম দাকোপ উপজেলায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
তবে এলাকায় যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে দাবি করে সাবেক সংসদ সদস্য ননী গোপাল মন্ডল বলেন, মোংলা বন্দরকে কাজে লাগিয়ে আমাদের এলাকা শিল্পাঞ্চলে পরিণত করা সম্ভব। এছাড়া সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্প, পোশাক শিল্প গড়ে তোলার মতো সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, এলাকায় এখনো ২-৩টি সেতুর প্রয়োজন রয়েছে। যা হলে এলাকার উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এরমধ্যে ঝপঝপিয়া-পোদ্দারগঞ্জ, কালাবগি-কৈলাশগঞ্জ উল্লেখযোগ্য। এই সেতুগুলোর বিষয়ে সরকার অবগত আছে বলেও জানান তিনি।
এফএ/এএসএম