তিনবেলা খাবার জোটে না, ঋণ নিয়ে ভাঙা সড়ক মেরামত করেন আলী
মিস্টার আলী, বয়স ৫০ বছর। পেশায় একজন ভ্যানচালক হলেও নেশা তার রাস্তা মেরামত করা। পথচারীদের উপকার হবে এমন ভেবে ১২ বছর ধরে বিভিন্ন ভাঙা রাস্তার মেরামত করে আসছেন। এলাকার যেকোনো রাস্তাঘাটে খানাখন্দ বা গর্ত দেখলেই নেমে পড়েন মেরামতের কাজে। সকালে ভ্যান চালালেও দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা অবধি করেন ব্যস্ত থাকেন রাস্তায়। তাই এলাকাবাসী তাকে ‘এমপি’ বলেও সম্বোধন করেন।
মিস্টার আলী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের পোড়াডিহি গ্রামের বাসিন্দা। তিন সন্তানের জনক তিনি। পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের বাধাও তাকে আটকাতে পারেনি রাস্তা মেরামতের কাজ থেকে।
স্থানীয়রা জানান, মিস্টার আলী রাস্তা ঠিক করতে মাঝে মধ্যে ঋণ নিয়েও ইট-বালু কিনেন। এমনকি কোনো রাস্তা ভাঙা দেখলে নিজের বাড়ির ইট খুলে মেরামত করেন।
সোহেল রানা নামে এক রাজমিস্ত্রি বলেন, তার বাড়িতে তিনবেলা খাবার থাকে না ঠিকই। কিন্তু রাস্তা ভাঙা দেখলে তার কষ্ট হয়। এজন্য ঋণ নিয়ে, এমনকি বাড়ির ইট চুরি করে হলেও তিনি রাস্তা মেরামত করেন। এটি বলা যায় তার নেশা।
তিনি আরও বলেন, তার এমন কাজে আমরা উপকৃত হই। তবে কষ্টে থেকে যান তিনি। কারণ, তার নেই কোনো অর্থ সম্পদ।
জিয়াউর নামে এক স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘চৌকা-মনাকষা সড়কটি বেশ কিছুদিন থেকেই ভাঙা ছিল। এটি চোখে পড়ে মিস্টার আলীর। তিনি নিজেই ইট কিনে এনে ভাঙার পর রাস্তায় দিয়েছেন। এতে সাধারণ মানুষদের ভোগান্তি কমে এসেছে। তাই এলাকার মানুষ মিস্টার আলীকে এমপি নামেও চেনেন। এখানে স্থানীয় এমপির বাসাবাড়ি কেউ না চিনলেও মিস্টার আলীর বাসা সবাই চিনেন।
তিনি আরও বলেন, তাকে এমপি নামে ডাকার কারণ হচ্ছে, রাস্তা ভেঙে গেলে মেরামত করেন জনপ্রতিনিধিরা। এ এলাকার অনেক রাস্তায় ভাঙা ছিল। সেদিকে নজর ছিল না জনপ্রতিনিধিদের। কিন্তু সে সময় বসেছিলেন না মিস্টার আলী। তার ঠিকই নজর থাকে ভাঙা রাস্তার ওপর। আমাদের জনতার এমপি মিস্টার আলী।
রফিকুল ইসলাম নামে এক মোটরসাইকেলচালক বলেন, মিস্টার আলী গরিব মানুষ। তিনি পেশায় একজন ভ্যানচালক। কিন্তু এ ভ্যান চালিয়ে যে রোজগার হয়, তা দিয়ে তার সংসার চালানোর কথা। কিন্তু তা না করে রোজগারের সব টাকা দিয়ে ইট বালু কিনে রাস্তা মেরামত করছেন। এতে উপকার হচ্ছে পথচারী ও যাত্রীদের।
মিস্টার আলির ছেলে শাহিন আলী বলেন, বাবাকে অনেকবার নিষেধ করার পরও তিনি রাস্তা মেরামতের কাজ ছাড়েননি। এমনকি বাড়ির ইট খুলে নিয়েও তিনি রাস্তা মেরামত করেন। এতে দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমরা গরিব মানুষ দিনমজুরের কাজ করে খাই।
মিস্টার আলীর স্ত্রী শাহাজাদী বেগম বলেন, অভাবের সংসারে খরচ ঠিকমতো না দিয়ে উল্টো রাস্তা ঠিক করেন আমার স্বামী। এটি ভালো কাজ এটি আমি জানি। কিন্তু কি করবো আমরা যে গরিব অসহায়। আমাদের তো দিনে তিনবেলা খাবারই জুটছে না। মানা করলেও আমার স্বামী রাস্তা মেরামতের কাজ ছাড়তে পারে না। কিছুদিন আগে আমার রান্নাঘরের পাশে একটি দেওয়াল ছিল। আমাদের না জানিয়ে পরশু সেই দেওয়ালের ইটগুলো খুলে নিয়ে রাস্তায় দিয়েছেন।
মিস্টার আলী মানসিক ভারসাম্যহীন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না এমনটা না। তবে মেরামত করা তার নেশা।
মিস্টার আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমি একজন ভ্যানচালক। রাস্তা ভাঙা থাকলে ভ্যান চালাতে কষ্ট হয়। এছাড়া ভ্যানের অনেক যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়। এটি আমি দেখে সহ্য করতে পারি না। তাই আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করি রাস্তা মেরামতের। আমি এরই মধ্যে শিবগঞ্জের গোপালপুর, পারচৌকা, হঠাৎপাড়া, মনাকষা, বাখোরআলী বাজার, কালিগঞ্জ, কাপরাটোলা, রসুনচক, শ্যামপুর, সাতরশিয়া গ্রামের রাস্তা সংস্কার করেছি।
তিনি আরও বলেন, আমার এ কাজের জন্য পরিবারের লোকজন আমাকে অনেক বকাবকি করে। কিন্তু এটি আমার নেশা। এ কাজ আমি ছাড়তে পারবো না। তাই সরকারের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ যেন আমাকে যেন এমন একটা কাজ দেওয়া হয়। এতে আমার সংসারও চলবে রাস্তা মেরামতও করতে পারবো। তাহলে আমার স্ত্রীসহ আমার পরিবারের লোকজন আমাকে আর বকাবকি করতে পারবে না। এমনকি গ্রামবাসীও আমাকে পাগল বলবে না। তবে এখন স্থানীয়রা অনেকে আমাকে সম্মান করেন এবং এমপিও বলে ডাকেন।
এদিকে মিস্টার আলীর এ স্বেচ্ছাশ্রম নিয়ে খুব একটা সন্তুষ্ট নন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এমনকি এ বিষয়ে তারা কথা বলতেও আগ্রহী নন।
তবে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হায়াত জাগো নিউজকে বলেন, মিস্টার আলী রাস্তা মেরামতের কাজ করতে পছন্দ করেন। এটি তার নেশা বললেই চলে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা তাকে সহায়তা করব।
এসজে/জিকেএস