পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে রপ্তানিতে পিছিয়ে নওগাঁর আম
আমের জেলা নওগাঁ। এরইমধ্যে সারাদেশে এ জেলার আমের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি বিদেশেও রয়েছে এ জেলার আমের চাহিদা। জেলার সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলা বরেন্দ্রভূমি। শুষ্ক মৌসুমে ধুলাবালি আর বর্ষায় কাদা। এঁটেল মাটি হওয়ায় এখানকার আম অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট।
জেলার এ তিন উপজেলা আমের জন্য বিখ্যাত হলেও শুধু সাপাহার উপজেলার আম রপ্তানি হচ্ছে গত দুই বছর থেকে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রপ্তানি করে আরও লাভবান হবেন বলে জানান আমচাষিরা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়- জেলার সাপাহার উপজেলার সাতটি বাগান মালিকের কাছ থেকে ১৪০ দশমিক ২১ মেট্রিক টন (৩ হাজার ৫০৫ দশমিক ২৫ মণ) আম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়েছে। এরমধ্যে আম্রপালি ১৪০ মেট্রিক টন এবং ব্যানানা ম্যাংগো দশমিক ২১ মেট্রিক টন পাঠানো হয়েছে। প্রতিমণের দাম ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। যার মূল্য প্রায় এক কোটি ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার ৬২৫ টাকা।
রপ্তানি করা দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে ১২ মেট্রিক টন, সুইজারল্যান্ডে ৯ মেট্রিক টন, সিঙ্গাপুরে ৭ মেট্রিক টন, কাতারে ৩৯ মেট্রিক টন, লন্ডনে ৬ মেট্রিক টন, কুয়েতে ১৬ মেট্রিক টন, দুবাইয়ে ১৬ মেট্রিক টন, বাহরাইনে ৮ মেট্রিক টন, নেদারল্যান্ডসে ৪ মেট্রিক টন ও পর্তুগালে ৫ মেট্রিক টন আম পাঠানো হয়েছে।
এ বছর জেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান করা হয়। প্রতি হেক্টরে ১২ দশমিক ৫০ মেট্রিক টন হিসেবে উৎপাদন প্রায় ৩ লাখ ৭৮ হাজার মেট্রিক টন। ৪৫০ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ১৪০ দশমিক ২১ মেট্রিক টন। এ বছর ৯০ লাখ পিস আমে ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে।
এ বছর রপ্তানির উদ্দেশ্যে ১৩০ জন চাষিকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। গত বছর ৭৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হয়েছিল।
বরেন্দ্র এলাকার এঁটেল মাটির আম অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট হওয়ায় এ জেলার আমের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। আম্রপালি, বারি-৪, ফজলি ও ব্যানানা ম্যাংগো জাতের আম বাজারে উঠেছে। ভোক্তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আম্রপালি জাতের আম। জেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের যে পরিমাণ আম বাগান রয়েছে তার মধ্যে আম্রপালি ১৮ হাজার ৩১৩ দশমিক ৫ হেক্টর। এ আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণ ভোক্তাদের আম খেতে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।
জানা গেছে, রপ্তানিযোগ্য আমের জন্য বিশেষ যত্ন নিতে হয়। মাছি ও পোকা আমের প্রধান শত্রু। নিরাপদ আম উৎপাদন করতে ফ্রুট ব্যাগিংসহ বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। পার্শ্ববর্তী জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে যে পরিমাণ আম রপ্তানি হয় নওগাঁ জেলা সে তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে। এ জেলায় নীরবে আমের বিপ্লব ছড়িয়ে গেলেও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে।
সাপাহার উপজেলার গোয়ালা ইউনিয়নের খোট্টাপাড়া গ্রামের আমচাষি তোফাজ্জল হোসেন। তিনি ৭৫ বিঘা জমিতে বিভিন্ন জাতের আম বাগান করেছেন। বাগানে ৩-৫ বছর বয়সের গাছ আছে। এ বছর তার বাগান থেকে আম যাচ্ছে বিদেশে। তবে তিনি সরাসরি রপ্তানি করছেন না বা রপ্তানিকারকের সঙ্গে চুক্তি করেননি। রপ্তানিকারকরা তার বাগানের আম কিনে নিয়ে রপ্তানি করছেন। এতে ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন তিনি। তবে সহযোগিতা পেলে আগামী বছর থেকে নিজেই রপ্তানি করবেন।
আমচাষি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আম রপ্তানি করবো এমন কোনো পরিকল্পনা বা চিন্তাধারা ছিল না। রপ্তানিকারকরা খোঁজ নিয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা প্রতিটি বাগানে আমের কোয়ালিটি অনুযায়ী পছন্দ করে আম পেড়ে প্যাকেটজাত করেন। বাজার থেকে মণে ৩০০-৪০০ টাকা দাম বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় আম্রপালি ১২০ মণ পর্যন্ত উত্তোলন করেছি। খুব যত্ন করে আমের পরির্চচা করা হয়েছে। তবে সহযোগিতা পেলে আগামী বছর থেকে নিজেই রপ্তানি করবো। এ বছর যে পরিমাণ আম আমার বাগান থেকে যাচ্ছে আগামীতে ৪-৫ গুণ বেশি পাঠাতে পারবো।
৫০০ বিঘার আম বাগানের মালিক উপজেলার চৌধূরীপাড়ার সাখাওয়াত হোসেন। ভালো দাম পাওয়ার আশায় এ বছর ১৪ লাখ ২০ হাজার পিস আমে ফ্রুট ব্যাগিং করেছেন। এরমধ্যে আম্রপালি ১০ লাখ ২০ হাজার পিস, গৌড়মতি ৬০ হাজার পিস, আশ্বিনা ৪০ হাজার পিস এবং বারী-৪ জাতের ৪ লাখ পিস।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রপ্তানিকারকরা বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে নিজেরাই রপ্তানি করছেন। আমাদের লাইসেন্স না থাকায় রপ্তানি করতে পারবো না। তবে সরকার যদি রপ্তানির প্রক্রিয়া করে দেয় তাহলে রপ্তানি করবো। এতে আমরাই লাভবান হবো। এ বছর ৫০-৭৫ মেট্রিক টন আম রপ্তানিকারকদের কাছে বিক্রি করার আশা রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আস্থা’ কোম্পানি আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। প্যাকেটের মান খুবই খারাপ। আমে ফ্রুট ব্যাগিং করতে ৪ টাকা ৪৪ পয়সা দাম হিসেবে ‘আস্থা’ থেকে ৪ লাখ পিস ফ্রুট ব্যাগ কিনেছিলাম। প্রতিটি ফ্রুট ব্যাগ তিন মৌসুম পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। কিন্তু আস্থা ফ্রুট ব্যাগ এক মৌসুমেই শেষ। এ কারণে এর দাম হিসেবে ১৭ লাখ ৭৬ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। এছাড়া ব্যাগিং করা আমগুলো কালো হয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল তারা আমার বাগান থেকে বাজার মূল্যে আম কিনবে। এতে ফ্রুট ব্যাগিংয়ের দাম দিতে হবে না। কিন্তু তারা এখন আম না কিনে ব্যাগের দাম নিতে চাচ্ছে। অন্য কোম্পানির ফ্রুট ব্যাগে কোনো সমস্যা হয়নি।
উপজেলার বরেন্দ্র এগ্রো পার্কের স্বত্তাধিকারী সোহেল রানা বলেন, ১৫০ বিঘা আমের বাগান রয়েছে। এরমধ্যে দেড় বিঘা জমিতে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম্রপালি, বারি-৪, গৌড়মতি ও ব্যানানা ম্যাংগো উৎপাদন করা হয়েছে। গত বছর ২৫ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হয়েছিল। এ বছর ৫০ মেট্রিক টন রপ্তানির আশা।
আম রপ্তানির সমস্যাসমূহ নিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা সোহেল রানা বলেন, আমচাষি ও রপ্তানিকারকদের মধ্যে ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’ না হওয়া আবার চুক্তি করার পর চুক্তি অনুযায়ী চাষিদের আম না নেওয়া একটি বড় সমস্যা। এছাড়া সাপাহার থেকে ঢাকার দূরত্ব অনেক। এ কারণে সেখানে আম নিয়ে যাওয়ার পর মাণ ধরে রাখা সম্ভব হয় না। এজন্য আঞ্চলিক প্যাক হাউস প্রয়োজন। নিরাপদ আম উৎপাদনের জন্য ফ্রুট ব্যাগের দামও কমানো দরকরা। এছাড়া রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনে কৃষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এতে রপ্তানির জন্য আমচাষিদের আগ্রহ বাড়বে।
সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা. শাপলা খাতুন বলেন, গত বছর এ উপজেলা থেকে ৭৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছিল। এ বছর প্রায় ১৪০ মেট্রিক টন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় এবং সেটা অর্জিত হয়েছে। তবে আরও আম রপ্তানি হবে। এ লক্ষ্যে নিরাপদ আম উৎপাদনে প্রায় ৬০ লাখ পিস আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। এছাড়াও পরিমিত কীটনাশক ব্যবহারে প্রায় ৩০ হেক্টর জমির বাগানে পরিচর্যা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। আমচাষিরা রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে আম রপ্তানি করছে। যদি তারা এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে পারেন তাহলে নিজেরা আম রপ্তানি করতে পারবেন।
এফএ/জেআইএম