ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

৩৩ বছর ধরে এক টাকায় চা বিক্রি করছেন মহির উদ্দিন

হুসাইন মালিক | চুয়াডাঙ্গা | প্রকাশিত: ১২:২৫ পিএম, ২২ জুলাই ২০২৩

দুই দশক আগেও এক টাকায় মিলতো এক কাপ চা। এখন সেই চায়ের দাম বেড়ে হয়েছে ৫-১২ টাকা। প্রকারভেদে ৫০-১০০ টাকা। তবে বর্তমানে এ উচ্চ মূল্যের বাজারে কি এক টাকায় এক কাপ চা পাওয়া সম্ভব!

শুনতে অবাক লাগলেও দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে এক টাকা কাপ চা বিক্রি করে আসছেন চুয়াডাঙ্গার মহির উদ্দিন। তিনি দামুড়হুদা উপজেলার নাটুদাহ ইউনিয়নের সদর-বোয়ালমারি এলাকার বাসিন্দা। এত কম দামে চা বিক্রির কারণে তার গ্রামটিও নতুন পরিচিতি পেয়েছে—‘এক টাকার মোড়’ নামে। তবে অনেকে ‘ভাইরাল চায়ের মোড়’ নামও বলে থাকেন।

সম্প্রতি এক টাকার মোড়ে গিয়ে দেখা যায়, পাকা রাস্তার এক পাশে ছোট দোকান। অনেকটা খোলা আকাশের নিচে চা তৈরির চুলা। বসার জন্য রয়েছে বাঁশের তৈরি মাচাল। দোকানে পানের ডালাও আছে।

একসময় এক টাকার চায়ের সঙ্গে এক টাকায় পানও বিক্রি করতেন মহির উদ্দিন। তবে বর্তমানে শুধু এক টাকায় চা বিক্রি করছেন। আর পান বিক্রি করেন ৩-৪ টাকায়। দোকানে অনেককে চা পান করতে দেখা গেলো।

আরও পড়ুন: দুই দোকানে মাসে ৬ লাখ টাকার চা বিক্রি

সেখানে চা পান করছিলেন হারুন উর রশিদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাড়ি পাশের গ্রামে হলেও থাকি চট্টগ্রামে। আমার নানির বাড়ি এই বোয়ালমারী গ্রামে। ফেসবুকে দেখেছি এখানে এক টাকায় চা বিক্রি হয়। তাই চা পান করতে এসেছি। এটা অবাক করার বিষয় যে এই দূমূর্ল্যের বাজারে প্রায় ৩৩ বছর এক টাকায় চা বিক্রি করছেন মহির উদ্দিন। এটা আসলেই প্রশংসনীয়।

চা পান করতে আসা পার্শ্ববর্তী গ্রামের তরুণ লিজন শেখ বলেন, ‘বাপ-চাচাদের কাছ থেকেই শুনেছি, মহির উদ্দিন ১৯৯০ সাল থেকে এক টাকার চা বিক্রি করে আসছেন। তাই চা পান করতে এসেছি। চাও সুস্বাদু।’

মেহেরপুরের মুজিবনগর থেকে আসা সোহাগ জাগো নিউজকে বলেন বলেন, আমার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি যে এক চাকায় চা পাওয়া যায়। এখানে এসে দেখলাম আসলেই সত্যি। চায়ের স্বাদও চমৎকার।

আমানত আলী ও রিপন আলী চা পান করতে করতে বলেন, ‘মহির উদ্দিনের এক টাকার চা ১০ টাকার চায়ের থেকেও সুস্বাদু।’

একই গ্রামের বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, ‘মহিরের চা পান করছি ৩৩ বছর ধরে। তিনি এক টাকায় চা বিক্রি করছেন। আগে এক টাকা দাম ঠিক থাকলেও এখন এটা আসলেই তার লোকসানের।’

একই এলাকার আটকবর এলাকার বাসিন্দা হেবুল ইসলামও এসেছেন এক টাকার চা পান করতে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ২০১৩ সালে পানের ব্যবসা করতাম, তখন থেকেই দেখছি উনি এক টাকায় চা বিক্রি করেন। আগে ওনার এক টাকার চা বিক্রি করে লাভ হলেও এখন হয় না। ওনি যে কেন এখন এক টাকায় চা বিক্রি করছেন বলতে পারবো না। হয়তো উনার শখ।’

আরও পড়ুন: এক দোকানে ৫৩ রকমের চা

কথা হয় এক টাকায় চা বিক্রি করা মহির উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ব্যবসায় মুনাফা করা আমার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। আমি চাই গ্রামের খেটেখাওয়া স্বল্পআয়ের মানুষগুলো সকাল-বিকেল একসঙ্গে বসে চা-পান করতে করতে পরস্পরের খোঁজখবর নিক, গল্পগুজব করুক। এতে গ্রামের সবার মধ্যে সম্প্রীতি বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সাল থেকে এক টাকায় চা ও এক টাকায় পান বিক্রি শুরু করি। তবে এখন পান আর এক টাকায় বিক্রি করি না। ৩-৪ টাকায় পান বিক্রি করি। অনেক সাংবাদিক ভুলভাল তথ্য দিয়ে লিখেছেন আমি নাকি পানও এক টাকায় বিক্রি। এটা সঠিক না। আমি শুধু শখের বশে ৩৩ বছর ধরে এক টাকায় চা বিক্রি করছি। যতদিন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন, এক টাকায় চা বিক্রি করে যাবো।’

মহির উদ্দিন বলেন, ‘আমি এক টাকায় চা বিক্রি করি, অনেকেই বিশ্বাস করেন না। অনেকেই বাজি ধরে এখানে চা পান করতে আসেন। পরে তারা বাজিতে হেরে যান। আমার এখানে শুধু আমার গ্রামের মানুষ নয়, সকাল-বিকেল দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষ ভিড় করেন।’

এতো কম দামে চা-পান বিক্রি করে সংসার চলে কীভাবে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিজের কৃষিজমিতে চাষ করাসহ ৯ কাঠা জমিতে পানের বরজ আছে। মাঝেমধ্যে অন্যের জমিতেও দিনমজুরের কাজ করি। এভাবেই আমার সংসার আল্লাহ চালিয়ে দেন।’

প্রতিদিন ফজরের নামাজ পড়ে দোকান খোলেন মহির উদ্দিন। এরপর সকাল ৮টা পর্যন্ত চা-পান বিক্রি করি। এরপর সারাদিন কাজ শেষে আবার বিকেল হলে দোকান খোলেন। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। প্রতিদিন চা-পান বিক্রি করে ৩০০ টাকার মতো আয় হয়।

আরও পড়ুন: বাহারি খাবারের রাজ্য ‘পল্লী ফুড ভিলেজ’, দামও সস্তা

মহির উদ্দিনের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে মহাজনপুর কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। মহির উদ্দিন বলেন, ‘এখন স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তবে যে পরিমাণ মানুষ চা পান করতে আসছেন তাতে আমার লোকসান বাড়বে। তারপরও আমি এক টাকায় চা বিক্রি করে যাবো।

নাটদাহ ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের (বোয়ালমারী গ্রাম) মেম্বার সানারুল ইসলাম বলেন, ‘মহি ভাইকে (মহির উদ্দিন) সাধুবাদ জানাই। কারণ তার জন্য সারা দেশের আমার গ্রামটিকে চিনছেন। গ্রামের সুনাম ছড়িয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মহি ভাই নিম্নআয়ের মানুষ। তার এক টাকায় চা বিক্রির বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে ভাইরাল হয়েছে তাতে এখন প্রচুর কাস্টমার আসছেন। এতে তার চা-বিক্রি বেড়েছে, লোকসানও বাড়ছে। এভাবে চললে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমি চাই সরকারিভাবে তাকে সহায়তা দিয়ে একটা ভালো মুদিদোকান দিয়ে দিক।’

পার্শ্ববর্তী কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল করিম বিশ্বাস বলেন, মানুষকে এক টাকায় চা পান করান মহির ভাই। আমি নিজেও মাঝেমধ্যে এখানে চা পান করতে আসি। একজন নিম্নআয়ের মানুষও যে সমাজে অবদান রাখতে পারেন, তার উদাহরণ চা বিক্রেতা মহির উদ্দিন।

এসআর/এএসএম