ঝিমিয়ে পড়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড
১৫ বছরেও পুনর্নির্মাণ হয়নি ফেনীর জহির রায়হান মিলনায়তন
![১৫ বছরেও পুনর্নির্মাণ হয়নি ফেনীর জহির রায়হান মিলনায়তন](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2023March/feni-1-20230630191007.jpg)
ফেনীর সাংস্কৃতিক কর্মীদের তীর্থস্থান শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন ভেঙে ফেলার ১৫ বছর হয়ে গেছে। তবে এতদিনেও পুনর্নির্মাণ করা হয়নি এটি। এতে ঝিমিয়ে পড়েছে জেলার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। আশানুরূপভাবে তৈরি হচ্ছে না শিল্পী।
জেলার প্রবীণ সাংস্কৃতিক সংগঠক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সূত্র জানায়, স্বাধীনতাপরবর্তী সাংস্কৃতিক চর্চায় ফেনী ছিল এক ঐতিহ্যের জনপদ। এ মাটিতে জন্ম নেওয়া প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শহীদ জহির রায়হান, শহীদুল্লা কায়সার, নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন, চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিম, নাট্যব্যক্তিত্ব প্রয়াত ড. ইনামুল হকসহ বহু গুণীজন তাদের কর্মে জেলাকে আলোকিত করেছেন।
জেলা পরিষদ ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষাটের দশকের শেষ দিকে শহরের মিজান সড়কে জেলা পরিষদ ভবনের সামনে ৪৩ শতাংশ জমিতে নির্মিত হয় ‘ফেনী টাউন হল’। আশির দশকের শুরুতে ফেনী টাউন হলের নাম পরিবর্তন করে ‘শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তন’ রাখা হয়। এ হলে ’৭০ ও ’৮০’র দশকে নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীনের রচিত অনেক মঞ্চনাটক দর্শক মনে সাড়া ফেলেছিল।
স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসন এ মিলনায়তনটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় ফেনী পৌরসভাকে। ফেনী পৌর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকা ৪০০ আসনের এ মিলনায়তনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান হতো। শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, গণগ্রন্থাগার ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় ছিল। মিলনায়তন ভবনের দশটি পৃথক কক্ষ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনকে বরাদ্দ দেয়। কক্ষগুলোতে সারা বছর সংগঠনগুলোর গান, নাচ ও নাটকের মহড়া হতো।
আরও পড়ুন: ঝিমিয়ে পড়া নাট্যাঙ্গনকে চাঙ্গা করতে পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন
জেলা পরিষদের মালিকানায় শহীদ জহির রায়হান মিলনায়তনটি ২০০৮ সালের শেষের দিকে ভেঙে সেখানে আরও বেশি আসনের একটি আধুনিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মিলনায়তনটি পুনর্নির্মাণের জন্য এডিবি থেকে দেড় কোটি টাকার প্রাথমিক বরাদ্দও দেওয়া হয়। তবে নতুন ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় ভেঙে ফেলার ১৫ বছর অতিবাহিত হলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আধুনিক ভবন নির্মিত হয়নি।
ভবন নির্মাণ শুরু করা দূরের কথা; ভবনের নকশাও অনুমোদন হয়নি এখনো পর্যন্ত। ভবন ভেঙে ফেলায় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কার্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন সাংস্কৃতিক কর্মীরা মহড়া দিতে পারছেন না। এতে জেলায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে।
ফেনী থিয়েটারের সাবেক সমন্বয়ক কাজী ইকবাল আহম্মদ বলেন, ‘মিলনায়তনটি ভেঙে ফেলায় বর্তমানে ফেনীতে নাট্যচর্চায় স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। অথচ নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন ও চলচ্চিত্র নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমও এ মিলনায়তনে নাটক করেছিলেন।’
আলাপন আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ফেনীর সাধারণ সম্পাদক আবৃত্তি শিল্পী নাজমুল হক শামীম বলেন, ‘মহড়া কক্ষের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে আবৃত্তি চর্চা করতে বেগ পেতে হচ্ছে। অন্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বাসাভাড়া নিয়ে সাংস্কৃতিক চর্চা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এতে নতুন শিল্পীরা বিকশিত হতে পারছেন না।’
নৃত্য সংগঠন পায়রার সভাপতি প্রবীণ শিল্পী জাহিদ হোসেন বাবলু বলেন, জেলায় সাংস্কৃতিক চর্চার কোন মঞ্চ বা মহড়া কক্ষ না থাকায় নৃত্যশিল্পীরা নিয়মিত অনুশীলন করতে পারছেন না। দুই দশক পূর্বে যেখানে সংগঠনে অর্ধশত নৃত্যশিল্পী ছিলেন সেখানে এখন হাতেগোনা অল্পকিছু শিল্পী নিয়ে সংগঠন পরিচালিত হচ্ছে।
নাট্যাচার্য ড. সেলিম আল দীন চর্চা কেন্দ্র ফেনীর সভাপতি আবৃত্তি শিল্পী রাশেদ মাযহার বলেন, জেলায় একমাত্র মঞ্চ রয়েছে শিল্পকলা একাডমিতে। সেখানে সাউন্ড, লাইটসহ বিভিন্ন যন্ত্র বিকল থাকায় বাইরে থেকে এসব ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হয়। হলভাড়া, সাউন্ড, লাইটসহ অন্যান্য সব খরচ মিলিয়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা গুনতে হয়। পৃষ্ঠপোষকহীন অনেকটা নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে চালানো সংগঠনের পক্ষে একটি প্রোগ্রামে এত টাকা খরচ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়।
আরও পড়ুন: সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দ্যুতি ছড়াচ্ছে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি
তিনি বলেন, ‘একসময় জহির রায়হান মিলনায়তনে টিকিট কেটে দর্শক অনুষ্ঠান দেখতো। আর এখন শিল্পকলা একাডেমিতে ফ্রি টিকিটেও কেউ যেতে চান না। সাংস্কৃতিক চর্চার পথ রুদ্ধ হওয়ায় পাড়ায় পাড়ায় এখন কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।’
বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট ফেনী জেলা শাখার সভাপতি শান্তি রঞ্জন চৌধুরী বলেন, কোনো এক অদৃশ্য বাধায় এটি পুনর্নির্মাণ হচ্ছে না। জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি হলটি দ্রুত পুনর্নির্মাণ করা হোক।
জহির রায়হান হল পুনঃপ্রতিষ্ঠা মঞ্চের সদস্য সচিব আসাদুজ্জামান দারা বলেন, জহির রায়হান হল পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছি। সংশ্লিষ্টদের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এটি দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়িত হয়নি।
তবে অন্য সময়ের চেয়ে ফেনীতে সাংস্কৃতিক চর্চা অনেক বেড়েছে বলে দাবি করেন জেলা কালচারাল অফিসার এসএমটি কামরান হাসান। তিনি বলেন, হলের যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো সমাধানে কাজ চলছে।
ফেনী পৌরমেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী বলেন, বর্তমানে এটি জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে। হল নির্মাণে পৌরসভাকে সম্পৃক্ত করা হলে ফেনী পৌরসভা সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।
ফেনী জেলা পরিষদের প্রশাসক খায়রুল বশর মজুমদার তপন বলেন, ভবনের জন্য দেড় কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। নতুন বরাদ্দ ও নকশা পেলেই কাজ শুরু করা যাবে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে হলটি পুনর্নির্মাণ হচ্ছে না। তবে আমলাতান্ত্রিক বিষয়টি বাদ দিয়ে স্থানীয় উদ্যোগে এ হল নির্মাণের সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি জেলা উন্নয়ন সভায় হলটি নির্মাণের জন্য দ্রুত যথাযথ ব্যবস্থা নিতে জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এসআর/এএসএম