জীবনে গতি ফিরিয়েছে পদ্মা সেতু
একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল কঠিন। লঞ্চ বা ফেরি দিয়ে পার হতে হতো পদ্মা নদী। এই নদী পার হতে গিয়ে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। ভোগান্তির কথা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে ঈদযাত্রা ছিল যেন দুঃসহ স্মৃতি। ফেরি বা লঞ্চ না পেয়ে ঈদে বাড়ি যাওয়া হতো না অনেকের। এছাড়া যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যও ছিল কঠিন। ট্রাকেই নষ্ট হতো বিভিন্ন পণ্য। এসব এখন শুধুই স্মৃতি। এক পদ্মা সেতুই সব পাল্টে দিয়েছে। এখন আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথে অপেক্ষা করতে হয় না। কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ঘাটের ভোগান্তির আতঙ্ক নেই। কম সময়ে সহজেই গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষ। পণ্য পরিবহন, অ্যাম্বুলেন্সসহ এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে যেন গতি ফিরেছে।
আরও পড়ুন: ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে পদ্মা সেতু
এবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুর একবছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়। অথচ এই সময়ের আগে মাদারীপুরবাসীসহ দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ঘাট ছিল আতঙ্কের। ঝড়, ঘন কুয়াশা, নাব্য সংকট, তীব্র স্রোতের জন্য জীবনের ঝুঁকি ছিল মানুষের। অসুস্থ হলে ঢাকায় আসা ছিল আরও কষ্টের। গত বছরের ২৫ জুনের পর এসব কষ্ট এখন আর নেই।
মাদারীপুর শহরের স্নাক ইন রেস্টুরেন্টের মালিক রাকিব মাহফুজ বলেন, আমার ছেলে অসুস্থ। এখন প্রায় ঢাকা যেতে হচ্ছে। আমি আগে থেকে সিরিয়াল দিয়ে রাখি। এরপর ভোরে রওনা হই। ডাক্তার দেখিয়ে আবার রাতেই মাদারীপুর ফিরে আসি। আগে এটা ছিল অসম্ভব। এখন পদ্মা সেতুর জন্যই সম্ভব হয়েছে।
মাদারীপুরের ট্রাকচালক আনোয়ার শিকদার বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে ট্রাক চালাই। আগে আমাদের কাছে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ঘাট মানেই আতঙ্ক ছিল। সিরিয়াল না পাওয়ায় এমনও ছিল যে, ১০ দিনও ঘাটে বসে থাকতে হয়েছে। কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। কত যে ভোগান্তি ছিল, তা বলে বোঝানো যাবে না। এখন সেই পদ্মা নদী মাত্র ছয় মিনিটে পার হই। পদ্মা সেতুর জন্যই তা সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন: গর্বের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ছবি
ঢাকায় একটি কোম্পানিতে কাজ করেন রেজা সরদার। তিনি বলেন, ঈদ এলেই কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া ঘাট মানেই ছিল ভোগান্তি। অনেক সময় ভোগান্তির কথা চিন্তা করে মাদারীপুরের নিজ বাড়ি যেতাম না। ঢাকায়ই ঈদ করতাম। ঈদের পরের দিন মাদারীপুর যেতাম। আর এখন প্রতি সপ্তাহে পরিবারের কাছে যাই। তাই পদ্মা সেতু আমাদের জন্য পরম পাওয়া।
স্থানীয় শিক্ষক মাহবুব হোসেন বলেন, আমি বাসে চড়তে পারি না। বাসে উঠলেই বমি হয়। কিন্তু ঢাকায় বিভিন্ন কাজ থাকে। কি করবো বাধ্য হয়ে যেতেই হতো। অনেক সময় অটোরিকশা ভাড়া করে ছিলারচর হয়ে ভেতরের একটি ছোট রাস্তা দিয়ে কাঁঠালবাড়ি ঘাট পর্যন্ত গিয়ে লঞ্চে উঠতাম। তবে শুনলাম আগামী মাসে পদ্মা সেতুতে রেল চালু হচ্ছে। রেল চালু হলে শান্তিতে ঢাকা যেতে পারবো। শুনেছি রেলগাড়ির জার্নিতে বমি হয় না। তাই রেল চালু হলে আমি রেলগাড়িতে করেই ঢাকা যাবো। এছাড়া আমি কখনও রেলগাড়িতে চড়ি নাই। এই পদ্মা সেতুর জন্যই রেলগাড়িতে চড়তে পারবো। এতে আমরা মাদারীপুরবাসী খুব খুশি।
মাদারীপুর জেলা বাস ও মিনি বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মফিজুর রহমান হাওলাদার বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত হয়েছে। জেলায় এখন পাঁচটির মতো পরিবহন বেড়েছে। সংযুক্ত হয়েছে এসি পরিবহনও।
আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু থেকে ১০ মাসে ৬৬০ কোটি টাকা টোল আদায়: কাদের
মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী বলেন, যদিও আমাদের জন্য ভিআইপি ফেরি ছিল, তারপরও পদ্মা পার হতে সময় লাগতো। এছাড়া প্রকৃতি দুর্যোগের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হতো পদ্মা। এখন এই পদ্মা সেতুর জন্য খুব সহজেই নদী পার হতে পারছি। অনেক সময় সকালে এসে শিবচরের কাজ শেষ করে ঢাকা যাই। আবার ঢাকার কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় শিবচর এসে কাজ করতে পারছি।
মাদারীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য শাজাহান খান বলেন, আমার নিজ এলাকা মাদারীপুরে বারবার আসতে হতো। কিন্তু আগে ইচ্ছা থাকলেও অনেক সময় ঢাকা থেকে মাদারীপুরে আসতে পারতাম না। এখন ইচ্ছা করলেই দুবার আসা-যাওয়া যায়। এই পদ্মা সেতুর জন্যই আমি আমার নিজ এলাকার জনগণের কাছে বেশি আসতে পারছি।
মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ড. আবদুস সোবাহান গোলাপ বলেন, কালকিনিতে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। এই কাজগুলো করার সময় অনেক ক্ষেত্রে ঢাকা থেকে মালামাল আনতে হতো। তখন অনেক সময় ফেরিতে সিরিয়াল পাওয়া যেতো না। এছাড়া ফেরিতে সময়ও লাগতো অনেক। আর এখন পদ্মা সেতুর জন্য সব সহজ হয়েছে। সকালে ট্রাকে মালামাল পাঠিয়ে দিলে, সেই মালামাল দিয়ে ওদিনই শ্রমিকরা কাজ করতে পারেন।
জেডএইচ/এমএস