কবে হবে টাঙ্গাইলের ৯ মডেল মসজিদ
টাঙ্গাইলের ৯ উপজেলার ৯টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। স্থান নির্ধারণে জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়হীনতা, জমি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের গাফিলতির কারণে জেলার কালিহাতী, দেলদুয়ার, সখীপুর, মির্জাপুর, ঘাটাইল, মধুপুর, ভূঞাপুর, নাগরপুর ও গোপালপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা যাচ্ছে না। ফলে সংশ্লিষ্ট উপজেলায় ওই প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থ বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ফেরত যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে যায়, দেশে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৮ হাজার ৭২২ কেটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে গণপূর্ত অধিদপ্তর ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের নতুন মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। মেয়াদ বাড়ানোর জন্য মোট খরচ ৮ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।
ওই প্রকল্পের অংশ হিসেবে টাঙ্গাইল সদরে একটি এবং জেলার ১২টি উপজেলায় ১২টি মোট ১৩টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা শহরে মডেল মসজিদ নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ব্যতীত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা এবং উপজেলাগুলোর প্রতিটির নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ব্যতীত ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সে মোতাবেক বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরে ১৩টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মধ্যে সাতটির দরপত্র আহ্বান করে। এরমধ্যে টাঙ্গাইল জেলা শহরে একটি এবং ধনবাড়ী ও বাসাইল উপজেলায় দুটি মডেল মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হয়। ওই তিনটি মডেল মসজিদ ১৭ এপ্রিল চতুর্থ ধাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে যুক্ত হয়ে ভার্চুয়ালি উদ্বোধন করেছেন।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় একটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে। কাজের অগ্রগতি ৭৬ শতাংশ। ২০১৯ সালে দরপত্র আহ্বান করা কালিহাতী, দেলদুয়ার ও সখীপুর উপজেলায় তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে ঠিকাদাররা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণ দেখিয়ে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়। পরে মডেল মসজিদ নির্মাণে গাফিলতির কারণে ওই তিনটির ঠিকাদারদের কার্যাদেশ (চুক্তিপত্র) বাতিল হয়েছে।
মির্জাপুর, ঘাটাইল ও মধুপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি নিয়ে জটিলতার বিষয়ে অংশীজনদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠকের পর সম্প্রতি নিরসন হয়েছে। এ তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে দ্রুত দরপত্র আহ্বান করা হবে। ভূঞাপুর, নাগরপুর ও গোপালপুর উপজেলায় তিনটি মডেল মসজিদ নির্মাণে স্থান নির্বাচন নিয়েই জটিলতা তৈরি হয়েছে। স্ব স্ব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা মসজিদের স্থান নির্বাচনে একমত হতে পারছেন না। এরমধ্যে নাগরপুর উপজেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরপর তিনটি স্থান বাছাই করেন। পরে সর্বসম্মতিক্রমে উপজেলা পরিষদের ভেতরে স্থান নির্বাচন করলে বুলবুল কাজী নামে এক ব্যক্তি অধিকার ক্ষুণ্নের অভিযোগ এনে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করেন। ফলে মডেল মসজিদ নির্মাণের ‘স্থান নির্বাচন’ স্থগিত আছে।
এদিকে গোপালপুর উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির বৈরাণ নদীর পশ্চিম (ডানতীর) পাড়ে নন্দনপুর এলাকায় মডেল মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচন করেন। কিন্তু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোপালপুর বাসস্ট্যান্ডের পূর্বপাশে প্রধান সড়ক ঘেঁষে মসজিদ নির্মাণের দাবি জানান। এ নিয়ে উভয় নেতার মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ায় এ উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণের স্থান নির্বাচন সম্ভব হয়নি।
ভূঞাপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণে প্রথমে ব্যক্তি মালিকানাধীন ভূমি নির্বাচন করে অধিগ্রহণ করতে চাইলে ওই ব্যক্তি আদালতে মামলা করে নিষেধাজ্ঞা জারি করান। পরে সড়ক ও জনপথের পরিত্যক্ত ২৩ শতাংশ ভূমি নির্বাচন করে মডেল মসজিদ নির্মাণে অনুমোদন চাওয়া হয়। কিন্তু সওজ কর্তৃপক্ষ ১০ শতাংশ ভূমির অনুমোদন দেয়। মডেল মসজিদ নির্মাণে ওই পরিমাণ জমি পর্যাপ্ত না হওয়ায় তা স্থগিত করা হয়েছে।
কালিহাতী মডেল মসজিদ নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দাস ট্রেডার্সের মালিক পাপন কুমার ভানু জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম দিকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অসহযোগিতায় কাজ করা যায়নি। এখন করোনার ধাক্কার পর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মসজিদটি নির্মাণ করতে পারছি না।
ভূঞাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বেলাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জমি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ভূঞাপুরে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি নির্মাণ করা যায়নি। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের কাছাকাছি মডেল মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠান্ডু জাগো নিউজকে বলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্যের পছন্দ না হওয়ায় গোপালপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে মডেল মসজিদ নির্মাণ সম্ভব হয়নি। তিনি যেখানে মডেল মসজিদ নির্মাণ করতে বলেছেন, সেখানে বৈরাণ নদী পাড় হয়ে যেতে হয়। সেতু না থাকায় নদীর পূর্বপাড়ের মানুষ ওখানে যেতে পারবে না।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মূলত জনপ্রতিনিধিরা একমত হতে না পারায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি।
নাগরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুছ ছামাদ জাগো নিউজকে বলেন, মডেল মসজিদ নির্মাণে স্থান নির্বাচন করা হয়। কিন্তু বুলবুল কাজী নামে এক ব্যক্তি উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করার কারণে উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ কার্যত স্থগিত আছে।
টাঙ্গাইল গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় ১৩টি মডেল মসজিদের মধ্যে মাত্র তিনটির উদ্বোধন হয়েছে। একটির ৭৬ শতাংশ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, বাকি কাজ চলমান আছে।
তিনি আরও বলেন, ৯টি উপজেলায় ৯টি মডেল মসজিদ নির্মাণ অনিশ্চিত পর্যায়ে আছে। এরমধ্যে তিনটি মসজিদ নির্মাণে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অজুহাতে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। পরে ওই তিনটি মসজিদের ঠিকাদারদের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) বাতিল করা হয়েছে। অপর তিনটি মসজিদের জমি সংক্রান্ত জটিলতা একাধিকবার অংশীজনদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরসন করা হয়েছে। জমি সংক্রান্ত জটিলতার জন্য ভূঞাপুর ও গোপালপুর উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা যাচ্ছে না।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জাগো নিউজকে বলেন, ৯টি উপজেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ না হওয়ার কারণ নির্ণয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন আনা হয়েছে। পরে মডেল মসজিদ নির্মাণের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ‘বিশেষ সভা’ করে নির্মাণ না হওয়ার কারণ নির্ধারণ ও পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হয়েছে। এ বিষয়ে জমি অধিগ্রহণসহ আইনি সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে স্ব স্ব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সহযোগিতা করলে প্রতিটি উপজেলায়ই মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র দ্রুত নির্মাণ করা হবে।
টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির জাগো নিউজকে বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকা গোপালপুর-ভূঞাপুরে মডেল মসজিদ নির্মাণে জমি নিয়ে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে অবস্থা এখন কেটে গেছে। ভূঞাপুর উপজেলার পাশে মডেল মসজিদ নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল এসে গোপালপুর উপজেলা সদরের তিনটি স্থান পরিদর্শন করে গেছেন। তারা যে স্থান নির্বাচন করবেন সেখানেই মডেল মসজিদ নির্মাণ হবে।
এ বিষয়ে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. নজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, দেশে মোট ৫৬৪টি মডেল মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ২০০টি মসজিদ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। অন্যগুলোও নির্মাণাধীন। স্থান নির্বাচনে শুধুমাত্র টাঙ্গাইল ও যশোর জেলা পিছিয়ে থাকায় মসজিদের নির্মাণ কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। তবে টাঙ্গাইলের কয়েকটি উপজেলায় জমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। প্রতিটি উপজেলায়ই মডেল মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ হবে এবং এর সুফল জনসাধারণ ভোগ করবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এসজে/জিকেএস