হবিগঞ্জ
জমির মালিকও পেয়েছেন আশ্রয়ণের ঘর
হবিগঞ্জে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দ পাওয়াদের অনেকেরই আছে নিজস্ব বাড়িঘর। কারও আবার জমিজমাও আছে। তাই তাদের ঘর তালাবদ্ধ থাকে দিনের পর দিন। কেউ আবার গরিব স্বজন বা অসহায়দের দিয়ে ঘরের দখল বজায় রেখেছেন। আবার কেউ দিয়েছেন ভাড়া। তারা দখল ঠিক রাখতে মাঝেমাঝেই আশ্রয়ণের ঘরে আসেন কয়েক ঘণ্টার জন্য।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের আনন্দপুরে মুজিববর্ষে জেলাকে গৃহহীনমুক্ত করার অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে ১৩৫টি ঘর নির্মাণ করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘরগুলোর রং নীল। পরবর্তীকালে লাল রঙের আরও ১৮টি ঘর দ্বিতীয় পর্যায়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেখানে ১ থেকে ৯ নম্বর ঘর পর্যন্ত মাত্র দুটি ঘরে বরাদ্দপ্রাপ্তরা থাকেন। প্রথম তিনটিসহ চারটি ঘর তালাবদ্ধ থাকে। বাকি তিনটিতে অন্যজন থাকেন।
আরও পড়ুন: আশ্রয়ণের ঘর ভাড়া-বিক্রি, কোনোটিতে ঝুলছে তালা
এরকম মোট ২০টি ঘরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে বরাদ্দপ্রাপ্তরা থাকেন না। অনেকেই গৃহহীন অসহায় দেখে অন্যজনকে থাকতে দিয়ে ঘর দখলে রেখেছেন। কেউ দিয়েছেন ভাড়া। কেউ আবার বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকে একদিনও আসেননি। ঘরটি তালাবদ্ধ। কেউ আবার মাঝে মাঝে এসে তালা খুলে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যান। তবে এর বাইরে এমন সাতটি ঘর চিহ্নিত করে তালা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। বিভিন্ন সময় ৪৮টি ঘরের বরাদ্দ বদল করে দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পের ৩৯ নম্বর ঘরের বাসিন্দা খায়রুন্নেছা বলেন, ভাদৈ গ্রামের আব্দুল হাই আমাকে ঘরটি দিয়েছেন। আমি অসহায় অবস্থায় পড়েছি বলে তিনি আমাকে থাকতে দিয়েছেন। আমি স্বামী, সন্তান নিয়ে এখানে থাকি। তার বাড়িঘর আছে। তিনি সেখানেই থাকেন।
প্রকল্পের আরেক বাসিন্দা মিনা বেগম বলেন, এখানে ঘর পাওয়া কয়েকজনের নিজস্ব বাড়িঘর আছে। তারা সেখানে থাকে। তিন-চার মাস পর পর তারা একবার আসে। ঘর পরিষ্কার করে কিছু সময় কাটিয়ে আবার চলে যায়। এভাবে ঘর দখলে রাখে। কয়েকজন আবার আরেকজনকে থাকতে দিয়ে চলে গেছে।
প্রকল্পের ৯ নম্বর ঘরের বাসিন্দা স্বপ্না বেগম জানান, তার চাচা দুলাল মিয়া তাকে ঘরটি দিয়েছেন। গ্রামে তার বাড়িঘর আছে। সম্পদ আছে। তিনি সেখানে থাকেন। আসেনও না। তিনি বলেন, আমার কিছুই নেই, নিঃস্ব। তাই চাচা ঘরটিতে থাকতে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: আশ্রয়ণের ঘর দেওয়ার নামে টাকা নেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা বহিষ্কার
আশ্রয়ণ প্রকল্পের শুরুর দিকের একটি ঘরে বাস করেন সহায়-সম্বলহীন এক বৃদ্ধা। এখন ঘর ছাড়ার আতঙ্কে আছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চার হাজার টাকা ভাড়া অগ্রিম দিয়ে ঘরটিতে উঠেছি। টাকাগ্রহীতা বলেছেন, আবার ঘরের বরাদ্দ এলে আমাকে দেবেন। এ ঘরটি তার খালা শাশুড়ির। আপাতত এখানে আমি যেন থাকি। কাউকে কিছু বলেছি শুনলে আমাকে বিদায় করে দেবে।
প্রকল্পের ১০১ নম্বর ঘরটি বরাদ্দ পেয়েছেন সদর উপজেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের বাসিন্দা কাছম আলী। পরিচয় গোপন করে জানতে চাইলে তার সহজ স্বীকারোক্তি, ওই গ্রামে তার নিজের বাড়ি আছে। জমিজমা আছে। তিনি কৃষিকাজ করেন। ঘর কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে দাবি করেন, পূর্ববর্তী চেয়ারম্যান তার চাচা হন। তিনিই ঘরটি বরাদ্দ দিয়েছেন। এখন ঘরটি খালিই আছে। কিন্তু খুঁজছেন একজন গরিব মানুষকে দেওয়া যায় কি না।
৩৯ নম্বর ঘরের বরাদ্দ পেয়েছেন পশ্চিম ভাদৈ গ্রামের আব্দুল হাইয়ের স্ত্রী কমলা বানু। তিনি জানান, ভাদৈ গ্রামে তাদের বাড়ি আছে। সেখানেই তারা থাকেন। বাড়িতে যাতায়াতের পথও বাতলে দেন। কিন্তু সরকারি ঘর বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলেই কমলা বলেন, আমার বাড়িঘর নেই। আমি এখন বাবার বাড়ি আছি।
ওই আশ্রয়ণ প্রকল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক যতীন্দ্র পাল বলেন, শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছে অনেক ঘরে লোক থাকে না। কেউ কেউ মাঝে মাঝে আসে-যায়। একেকটি ঘর পর্যায়ক্রমে তিনবার পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেখা গেলো কেউই থাকে না। অনেকগুলো ঘরই আছে যেগুলো দিনের পর দিন তালাবদ্ধ থাকে। অনেকেই আছে ঘর বরাদ্দ নেই, কিন্তু অন্যের ঘরে থাকছে। তাদের জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমার মামা, চাচা বা ভাইয়ের ঘর। কারা থাকে বা কারা থাকে না সবগুলো তালিকাই আমি এরইমধ্যে ইউএনও অফিসে জমা দিয়েছি।
প্রকল্পের সমিতির সভাপতি হিরা মিয়া বলেন, কেউ মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করে। অন্যকে দিয়ে কেউ দখল করে রেখেছে। তাদের বাড়িঘর, জমিজমা আছে। কখনো আসলে কিছু সময় কাটিয়ে চলে যায়। অথচ ঘরটি দখল করে রাখার কারণে একজন গরিব মানুষ ঘর পাচ্ছে না। অনেক ঘরই সারাবছর খালি থাকে।
সদর উপজেলার গোপায়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মন্নান জানান, তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার আগে ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কে কীভাবে তালিকা দিয়েছেন জানেন না। তবে এখানে যারা ঘর পেয়েছেন তাদের অনেকেরই বাড়িঘর আছে, জমিজমা আছে। তিনি বলেন, আমি দাবি জানাই যাদের বাড়িঘর আছে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে যেন প্রকৃত গৃহহীনকে ঘরটি বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সদর উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আলী নূর জানান, তিনি এখানে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নতুন যোগদান করেছেন। তাই বিষয়টি সম্পর্কে তেমন কিছু তার জানা নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়েশা আক্তার বলেন, যদি কারও জমি থাকে বা প্রকল্পের ঘরভাড়া দিয়েছে এ ধরনের প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাছাড়া যারা ঘরে থাকে নিশ্চয়ই তাদের বাড়িঘর নেই। আমরা তাদেরই ঘরগুলো বরাদ্দ দেব। এছাড়া অনেকেরই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কেউ হয়তো জায়গা-জমি কিনে চলে গেছে। এমনও হতে পারে। কিন্তু যখন তালিকা করা হয়েছিল তখন তার বাড়িঘর ছিল না। একজন নিজে থেকেই ঘর আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তার ঘরটি অন্যজনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: স্ত্রীকে বিদেশে পাঠানোর দেনা মেটাতে বিক্রি করলেন আশ্রয়ণের ঘর!
জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হতেই পারে। অনেকের হয়তো অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আগে জমি ছিল না, এখন সে জমির মালিক হয়েছে। কেউবা আবার কাজের জন্য অন্যত্র চলে যায়। আমি সবাইকেই বলে রেখেছি যেখানেই কোনো ঘর দীর্ঘদিন খালি থাকবে তখন সে ঘরের বরাদ্দ বাতিল করে অন্য আরেকজনকে দিতে। বিভিন্ন উপজেলায় এরকম হচ্ছে, এটি চলমান প্রক্রিয়া। যারা থাকে না তাদের কারও বরাদ্দ রাখা হবে না।
এমআরআর/এমএস