নেই আগের জৌলুস, অস্তিত্ব সংকটে কামারশিল্প
নীলফামারীর সৈয়দপুর পাঁচমাথা এলাকার রেললাইনের পাশের একটি কামারশালার মালিক মোহাম্মদ জাবেদ। বংশপরম্পরায় ৩২ বছরের বেশি সময় ধরে কামারের কাজ করেন তিনি। এক টুকরো লোহা দিলেই তৈরি করে দেন দা, ছুরিসহ নানা নিত্যব্যবহার্য বস্তু।
তবে আধুনিক মেশিনের সাহায্যে তৈরি দা-ছুরির ভিড়ে কামারদের হাতে তৈরি এসব বস্তুর চাহিদা দিনদিন কমছে। মেশিনের তৈরি চকচকে আর বাহারি হাতলের জিনিসই বেশি কিনছে মানুষ। এতে যেমন জৌলুস হারাচ্ছে এ শিল্প, তেমনি লোহা ও কয়লার দামবৃদ্ধির ফলে এ পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন কামারিরা।
আরও পড়ুন: আধুনিকতার ছোঁয়ায় অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে কামার শিল্প
ধারণা করা হয়, ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা গড়ে ওঠার পর রেললাইনের ধারে এই অঞ্চলের কামারশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরপর থেকে একটি দুইটি করে বর্তমানে অর্ধশতাধিক কামারশালা গড়ে উঠেছে সৈয়দপুর শহরে। এছাড়া জেলার ছয় উপজেলা মিলে প্রায় দেড়শ কামারশালা রয়েছে নীলফামারীতে।
তবে করোনা মহামারির ফলে বড় ধাক্কা খায় এ শিল্প। সেসময় বিক্রি কমে যাওয়ার ফলে বন্ধ হয়ে যায় কিছু কামারশালা। লোহা, কয়লার দামবৃদ্ধি ও শ্রমিক সংকটে রয়েছে কামারশালাগুলো। এছাড়া কামারদের তৈরি লোহার জিনিসের চাহিদা কমায় বর্তমানে কোনোরকম টিকে থাকা কামারশালাগুলোও বন্ধের উপক্রম। ফলে পেশা বদলাচ্ছেন অনেকে।
কামারশিল্পের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয় মোহাম্মদ জাবেদের সঙ্গে। দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, কোরবানির ঈদে আগে কিছু বেচাকেনা হতো। এখন তো মানুষ কসাই দিয়েই কেটে নেয়, নিজেরা কাটে না। আর আধুনিক জিনিস বের হইছে ওগুলাই কিনে মানুষ। তাছাড়া লোহার দাম বেশি, কয়লার দাম বেশি। কষ্টের তুলনায় টাকা কম। দৈনিক ৫০০ টাকা হাজিরা পায় শ্রমিকরা, সে টাকা দিয়ে তো বাজার করাই হয় না। এজন্য এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছে অনেকে।
আরও পড়ুন: অস্তিত্ব টেকাতেই গলদঘর্ম কামারদের
তিনি আরও বলেন, আমাদের যে আয় তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভালোমতো পড়াশোনা করাতে পারি না। উচ্চশিক্ষা দিতে পারি না। সরকারি সাহায্য পেলে আমরা একটু হলেও উপকৃত হবো।
আরেক কামারি মনির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কামারের ব্যবসা আর আগের মতো নাই। চিন্তা করতেছি পেশা ছেড়ে চলে যাইতে। যে কয়লা আর লোহার দাম তাতে কোনোভাবেই টিকতে পারছি না। তার ওপর মানুষ আমাদের কাছে জিনিস কিনছে না। দোকান থেকে আধুনিক মেশিনের বানানো জিনিস কিনছে। এজন্য ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে।
শ্যামল নামে কামারশালার এক শ্রমিক বলেন, আমরা বর্তমানে খুব কষ্টে আছি। জিনিসপত্রের দাম বেশি। কোনোভাবে চলতেছি। মহাজনদের বললে বলে, কয়লার দাম বেশি, লোহার দাম বেশি। বেতন কম তার ওপর মানুষ জিনিস কিনছে না। সব ঘুরে ফিরে ভোগান্তিতে আমরাই। সরকার যদি সাহায্য করতো, আমরা পেশাটা ধরে রাখতে পারতাম।
আরও পড়ুন: কামারপল্লীর রূপ পাল্টে দিয়েছে করোনা
এ বিষয়ে সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান জাগো নিউজকে বলেন, মৃতপ্রায় শিল্পগুলোকে টিকিয়ে রাখতে উপজেলা প্রশাসন থেকে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কেননা এসব আমাদের ঐতিহ্য। কামারশিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠের শিল্প, কুটিরশিল্পে যারা জড়িত আছেন আমরা বর্তমানে তাদের সার্ভে করছি এবং বাছাই করছি। আগামী অর্থবছরে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি।
তিনি আরও বলেন, যুবউন্নয়ন, সমবায় ও মহিলা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের ঋণের ব্যবস্থা করব, যাতে তারা পেশাটাকে কাজে লাগাতে পারে এবং উন্নতি করতে পারে।
রাজু আহম্মেদ/এমআরআর/এমএস