সিলেট নগরে ২১ বছরে সবুজ কমেছে ৫০ শতাংশ
সিলেটে নির্বিচারে চলছে বৃক্ষনিধন ও পাহাড়-টিলা কর্তন। বিগত ১০ বছরে উন্নয়নের নামে কেটে ফেলা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার গাছ। তোয়াক্কা করা হচ্ছে না বন বিভাগের অনুমতির। স্যাটেলাইট ছবির ভিত্তিতে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২১ বছরে সিলেট নগরে সবুজ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এর প্রভাব পড়ছে সিলেটের পরিবেশ ও প্রকৃতিতে।
বৃষ্টির সময়েও তীব্র দাবদাহে পুড়ছে সিলেটের মানুষ। গতবছরের জুন ও জুলাইয়ে দুই দফার স্মরণকালের বন্যায় তলিয়ে যায় সিলেট বিভাগ। পরিবেশ ও প্রকৃতি বিনাশী কর্মকাণ্ডের কারণেই এমন প্রাকৃতিক বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘প্রকৃতিকন্যা’ হিসেবে পরিচিত সিলেট এখন প্রকৃতি ধ্বংসের কারণে সেই সুনাম হারাতে বসেছে। সিলেটে বিগত পাঁচ বছরের অন্তত তিন শতাধিক ছোট-বড় পাহাড়-টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। ফলে পাহাড় ও টিলাধসের ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট অঞ্চল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট মহানগর ও এর আশপাশ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জে প্রায় প্রতিদিনই পাহাড়-টিলা কাটা হচ্ছে। ভরাট করা হচ্ছে দিঘি ও পুকুর। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে সিলেটের প্রকৃতিতে।
সিলেটে পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধে প্রশাসনের উদ্যোগ না থাকায় ‘পাহাড়-টিলা খেকোদের’ আগ্রাসন দিন দিন বাড়ছে। এতে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে বন্যপ্রাণীরা হারাচ্ছে আবাসস্থল। অনেক সময় বানরসহ নানা প্রজাতির বন্যপ্রাণী লোকালয়ে চলে আসে এবং প্রাণ হারায়।
শহরতলীর আরামবাগ এমসি কলেজ রোডে টিলা কাটা হয়েছে। ওখানে টিলা কেটে নির্মাণ করা হচ্ছে সিলডন হাসপাতাল। জাফলং, বিছনাকান্দি, জৈন্তাপুরের সংগ্রাম ও খাসিয়া পুঞ্জিতে পাহাড়-টিলা কেটে পাথর সংগ্রহ করা হচ্ছে। ওইসব টিলা ও পাহাড়ে থাকা বৃক্ষরাজিও কেটে সাবাড় করা হয়েছে।
পরিবেশ-প্রকৃতির বিপর্যয়ের প্রভাব সরাসরি পড়ছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। চলতি বছরের মে মাসে সিলেটে স্বাভাবিক পরিমাণের চেয়ে বৃষ্টিপাত অনেক কম হয়েছে। এতে হাওর, বিল ও নদী-নালায় পানি কমে যাওয়ায় মাছের প্রাকৃতিক প্রজননও কমেছে। হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে জালে মাছ পাচ্ছেন না মৎস্যজীবীরা। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এ পেশার সঙ্গে জড়িতরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের অফিস ইনচার্জ সজিব হোসেন জাগো নিউজকে জানান, সিলেট বিভাগে গত মে মাসে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা ছিল ৫৬৯ দশমিক ০৬ মিলিমিটার। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে হয়েছে ৩৩০ দশমিক ০৩ মিলিমিটার, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ২৩৯ দশমিক ০৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত কম। এ ভরা বর্ষা মৌসুমেও সিলেটের হাওরে এখনো পানি নেই।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়, টিলা ও সবুজ বনায়ন ধংসের কারণে বৃষ্টিপাতও কমে গেছে। পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ঘনঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। আমরা পাহাড়-টিলা কেটে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করে দিচ্ছি। সিলেটে গড় তাপমাত্রাও বেড়েছে।’
গত ৯ মে সিলেটে সর্বোচ্চ ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। অথচ মে মাসে স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা হওয়ার কথা ৩০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতমাসে স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি ছিল তাপমাত্রা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম চৌধুরী কিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ১০ বছরে সিলেট শহরে কমপক্ষে ১২ হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে উন্নয়নের নামে। কিন্তু পরিকল্পিতভাবে কাজ করলে এ গাছগুলো রেখেও উন্নয়ন করা যেতো। সড়ক প্রশস্ত হতো। বিদেশে সড়কের মধ্যভাগে গাছ রেখে দিয়েও সড়ক প্রশস্ত করা হয়।’
তিনি বলেন, সিলেট মহানগরে ও আশপাশ উপজেলায় প্রায় ৭০ শতাংশ জলাভূমি, পুকুর ও দিঘি ভরাট। জলাভূমি বিলীন হওয়ার কারণে জলাভূমিকেন্দ্রীক বৃক্ষ হিজল-করচ এখন বিলুপ্তির পথে। এ কারণে ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
গত বর্ষায় মহানগর ও আশপাশ এলাকায় একবারও একটি ব্যাঙের ডাকও শোনা যায়নি জানিয়ে নদীকর্মী কিম বলেন, ‘ব্যাঙের এ বিলুপ্তির কারণে সিলেটে মশা ও পোকা বেড়েছে। পরিবেশ ঠিকঠাক থাকলে ব্যাঙও থাকতো। একইসঙ্গে পোকা ও মশার প্রাদুর্ভাব কম হতো। পরিবেশের সঙ্গে জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক থাকায় সিলেটের সব কিছুই বদলে যাচ্ছে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমি মুখস্থ কোনো বক্তব্য দেই না। সিলেটে বৃক্ষনিধন, পরিবেশদূষণ ও পাহাড়-টিলা কাটা বন্ধে আমরা সক্রিয় রয়েছি। সীমিত সংখ্যক জনবল নিয়ে টিলা কাটা বন্ধে আমরা সর্বোচ্চভাবে চেষ্টা করছি। তারপরও কেউ পাহাড়-টিলা কাটলে পরিবেশ অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে।
গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা তৌফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমরা যেসব গাছ কাটার অনুমতি দিয়েছি, সেগুলো ভালো করে তদন্ত করে কাটার প্রয়োজনীয়তা দেখেই দিয়েছি। তবে গত এক বছরে কী পরিমাণ গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানাতে পারেননি তিনি।
পরিবেশকর্মীদের দাবি, ২০১৩ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সড়ক সম্প্রসারণ ও ড্রেন নির্মাণের নামে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই অপ্রয়োজনে কাটা হয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
পরিবেশ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ট্রাস্ট সিলেটের সভাপতি ডা. মোস্তফা শাহজামান বাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেবল সড়ক আর ফুটপাত করলেই উন্নয়ন হয় না। এ নগরে প্রতিদিন কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তার মাত্রা কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ আগামীতে টাকা থাকলেই বেঁচে থাকা যাবে না। যত বেশি সবুজ থাকবে, তত বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। এজন্য নগরের গাছগুলো রক্ষা করতে হবে।’
পরিবেশ সংগঠক অ্যাডভোকেট সুদীপ্ত অর্জুন জাগো নিউজকে জানান, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত নগরে কয়েক হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। উন্নয়নের কথা বলে এসব গাছ কাটা হলেও এর অনেকগুলোই কাটা হয়েছে অপ্রয়োজনে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে।
গুগলের স্যাটেলাইট ইমেজের ওপর ভিত্তি করে জিআইএস এবং রিমোট সেন্সিং ভিত্তিক হাইব্রিড ইমেজ ক্লাসিফিকেশন টেকনিকের মাধ্যমে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২১ বছরে সিলেট নগরের সবুজ কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। গবেষণাটি পরিচালনা করেন জিআইএস ও আরএস বিশ্লেষক সঞ্জয় রায়।
সবুজ কমে যাওয়ার জন্য অপরিকল্পিত নগরায়ন, নির্বিচারে গাছপালা কাটা, পাহাড়-টিলা কাটা ও জনসংখ্য বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন সঞ্জয় রায়। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ৩০ বছরে সিলেট নগর সবুজহীন হয়ে পড়বে বলে শঙ্কা তার।
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘নগরের পরিবেশের সুরক্ষায় আমরা সব সময়ই আন্তরিক। টিলা ও গাছ কাটা এবং জলাশয় ভরাট না করেই আমরা উন্নয়ন কাজ করছি। তবে বাধ্য হয়ে কিছু গাছ কাটতে হয়েছে। যদিও কাটার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি গাছ আমরা রোপণ করেছি। সিলেটকে একটি সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা কাজ করছি।’
বাপার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল জাগো নিউজকে বলেন, দখল-দূষণের কারণে সিলেটের প্রতিটি শহর এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে খাল, ছড়া, নদী ও বিল বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাঁচার তাগিদে সিলেটের জনজীবন ও পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক জনসম্পৃক্ত নাগরিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।
এসআর/জেআইএম