২৯ বছর ধরে প্লেন ওড়ে না কুমিল্লা বিমানবন্দরে
দেশের সর্বোচ্চ প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা কুমিল্লা। রেমিট্যান্সেও সেরা এই জেলা। বর্তমানে এই জেলার ১৫ লাখের বেশি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করছেন। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মাঝামাঝি অবস্থিত জেলাটি। ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ জেলা। এখানে ইপিজেড, বিসিক শিল্পনগরী ও গার্মেন্টসহ অনেক শিল্প-কারখানা রয়েছে। আছে একটি বিমানবন্দরও। এর ডিভিওআর ও ডিএমই সিগন্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় করে সরকার।
তবে সবকিছু ঠিক থাকা সত্ত্বেও বিমান ওঠানামা না করায় গত ২৯ বছর ধরে নিষ্প্রাণ কুমিল্লা বিমানবন্দরটি। রানওয়ে কার্পেটিং, ফায়ার বিগ্রেড ও এয়ারক্রাফটের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য টাওয়ারে বিএইচএফ সেট করলেই এ বিমানবন্দর থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলে বাধা থাকবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সূত্র মতে, ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেউরা-ঢুলিপাড়ার পাশে স্থাপিত হয় কুমিল্লা বিমানবন্দর। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে সেনাবাহিনী এ বিমানবন্দর ব্যবহার করতো। একই বছর বন্দরটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর বিমান ওঠানামা করে এ বন্দরে। কিছুদিন পর যাত্রী সংকটে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ১৯৯৪ সালে ফের বিমানবন্দরটি চালু করা হলেও পর্যাপ্ত যাত্রী না হওয়ায় মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এয়ারলাইন্সগুলো বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেয়। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক কোনো ফ্লাইট চালু না থাকলেও মূলত দেশের অভ্যন্তরের ফ্লাইটগুলো চালু ছিল এ বন্দরে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ৭৭ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিমানবন্দরটিতে এখন ভুতুড়ে পরিবেশ। হঠাৎ দেখে যে কেউ বোঝার উপায় নেই এটি একটি বিমানবন্দর। অধিকাংশ এলাকায় চাষ করা হয়েছে গরুর ঘাস। ভেতরে রয়েছে ছোট ছোট একাধিক পুকুর। বন্দরটি কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় হওয়ায় এবং যাত্রী ওঠানামা না করায় বিমানবন্দরের জন্য নির্মিত সড়কটি ঢুলিপাড়া, রসুলপুর ও রাজাপাড়া এলাকাবাসী ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
রানওয়ের পিচ উঠে পাথরের কণা ভেসে উঠেছে। তবে সচল রয়েছে ডিভিওআর ও ডিএমই-এর সিগন্যাল। এখান থেকে বর্তমানে প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৩০-৩৫টি বিমান দৈনিক সিগন্যাল ব্যবহার করছে। এতে প্রতি মাসে দুই থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকার রাজস্ব আয় হচ্ছে সরকারের। বেশি চলাচল করে ভারতে অভ্যন্তরীণ রুটের বিমান। আগরতলা বিমানবন্দরে যাওয়া বিমান এই রুটে চলে। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরের বিমান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু করতে বেশি অর্থের প্রয়োজন নেই। বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। অধিগ্রহণের ঝামেলা নেই। প্রয়োজন রানওয়ে কার্পেটিং, ফায়ার সার্ভিস ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারের জনবল। বর্তমানে এ বন্দরে ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন।
কুমিল্লা ইপিজেডের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, বিমানবন্দর চালু হলে ইপিজেডে আরও বেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী আসতেন। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হতো। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যাতায়াতের কথা বিবেচনা করে কুমিল্লা বিমানবন্দর যেন পুনরায় চালুর উদ্যোগ নিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, দীর্ঘদিন কুমিল্লা বিমানবন্দরে যাত্রী পরিবহন বন্ধ থাকায় ক্ষুব্ধ কুমিল্লার প্রবাসীরা। বিমানবন্দর থাকা সত্ত্বেও এর কার্যক্রম অসম্পূর্ণ থাকায় নিয়মিত বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন তারা। তাদের দাবি, প্রবাসী অধ্যুষিত কুমিল্লাবাসীর প্রাণের দাবি বিমানবন্দর পুনরায় চালু করা হোক।
সৌদি প্রবাসী আবদুর রশিদ বলেন, প্রবাসে অবস্থানের দিক থেকেও কুমিল্লার মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। রেমিট্যান্সেও সেরা কুমিল্লা জেলা। তা ছাড়া ঢাকা বিমানবন্দরে আমরা যখন নামি দেখা যায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা আমাদের অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। এরপর মহাসড়কে যানজট তো আছেই।
তিনি বলেন, প্রবাসীদের কথা বিবেচনা করে হলেও কুমিল্লা বিমানবন্দরটি পুনরায় চালু করা সময়ের দাবি।
কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মাসুক আলতাফ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, কুমিল্লা বিমানবন্দর সচল রয়েছে। সিগন্যাল থেকে আয়ও করছে। ২৫ জন জনবল রয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিমান ওঠানামা করে না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি সরকার পাঁচটি বিমানবন্দর চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মধ্যে কুমিল্লায় একটি। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো পর্যাপ্ত যাত্রী এবং অবকাঠামো উন্নয়ন। কুমিল্লায় দুইটাই রয়েছে। বর্তমানে অবকাঠামোগত যে অবস্থায় আছে তাতে এখনই বিমান ওঠানামা সম্ভব। পর্যাপ্ত যাত্রীরও একটি সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এখানে শিল্পকারখান রয়েছে। সরকার পর্যটন শিল্পের বিকাশ চায় এবং একই সঙ্গে আমাদের ইপিজেড রয়েছে। কারণ এখনো ঢাকা থেকে কুমিল্লায় আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে বিমানে আসলে মাত্র ২৫ মিনিট সময় লাগবে। কুমিল্লা বিমানবন্দর চালু হলে কমবে যাত্রীদের ভোগান্তি, সহজ হবে কুমিল্লার সঙ্গে ঢাকার ব্যবসায়িক যোগাযোগ। দ্রুত কুমিল্লা বিমানবন্দর চালু হওয়া সময়ের দাবি।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, কুমিল্লা বিমানবন্দর ভৌগোলিক কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখানে বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী স্থান হিসেবে কেবল মানুষের চলাচলই না, পণ্য পরিবহন ও অন্য ক্ষেত্রে এ বন্দরের অপার সম্ভাবনা রয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে দেশের অন্য কোথাও একটি বিমানবন্দর চালু করার জন্য যে বিনিয়োগ দরকার, সে জায়গায় এখানে সামান্য কিছু বিনিয়োগেই কুমিল্লায় বিমানবন্দর চালু করা সম্ভব। তাই ভৌগোলিক বিষয় বিবেচনা করে বিমানবন্দরটি অচিরেই চালু করা হোক, সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
কুমিল্লা বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক মো. তৌহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বিমানবন্দরটি সরকারের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ৩০-৩৫টি বিমান ডিভিওআর ও ডিএমই সিগন্যাল ব্যবহার করে। বিমান ওঠানামা না করলেও এটা থেকে ভালো রাজস্ব আয় হচ্ছে। বর্তমানে বিমানবন্দরটি চালু করতে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা নেই। রানওয়েটা কার্পেটিং, ফায়ার বিগ্রেড, এয়ারক্রাফটের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য টাওয়ারে বিএইচএফ সেট করার প্রয়োজন হবে। এগুলো হলেই বিমানবন্দরটি থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচলে আর বাধা থাকবে না।
তিনি বলেন, ২০-২৫ কোটি টাকা খরচ করলে এ বন্দরটিতে বিমান ওঠানামার কাজ শুরু করা যাবে। এ বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন মহলে কথা বলেছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে আরও ভালো জানতে পারবেন।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জাগো নিউজকে বলেন, কুমিল্লা বিমানবন্দরটি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত। চলতি বছরের মার্চে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তিনজন প্রকৌশলী কুমিল্লা বিমানবন্দর পরিদর্শন করেছেন। তারা এখনো কোনো ধরনের আপডেট জানাননি।
জেডআইপি/এমআরআর/জেআইএম