যে গ্রামের আয়ের উৎস আলুর চিপস
গেলো তিন মাস ধরে গ্রামটির চার শতাধিক বাড়ির প্রায় প্রতিটিতেই দুপুর থেকে গভীর রাত চলে আলু সিদ্ধ করার কাজ। সেই সিদ্ধ আলু গোলাকার করে কেটে বাড়ির উঠানে, নদীর পাড়, রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় রোদে শুকানো হচ্ছে। শুকানো আলু ভেজে চিপস তৈরি করে বিক্রি করছেন এসব গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের না শ্রীকৃষ্টপুর। এটি জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌরসভা এলাকায় অবস্থিত।
বর্তমানে গ্রামের শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীসহ সববয়সী মানুষ এই চিপস তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গ্রামের বসবাসকারী প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষই আলুর চিপস তৈরি ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। তাদের সারা বছরের আয়ের অন্যতম অবলম্বন এটি। আলুর চিপস তৈরির মাধ্যমে এ গ্রামের বেশির ভাগ পরিবারের অভাব দূর হয়েছে। হাতে তৈরি করা আলুর চিপসের ব্যাপক চাহিদাও রয়েছে স্থানীয় বাজারে। শুধু তাই নয়, এসব আলুর চিপস আবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
সম্প্রতি শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে বাড়িতে কেউ আলু সিদ্ধ করছেন, আবার কেউ সিদ্ধ আলু গোলাকার করে কাটছেন। কাটা আলুর ফালিগুলো তুলসীগঙ্গা নদীর পাড়, বাঁধ, রাস্তা, পুকুর পাড়ে রোদে শুকাচ্ছেন।
আলুর চিপস তৈরির কাজে নিয়োজিত লুৎফর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, কার্ডিনাল জাতের আলু চিপস তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়। অন্য জাতের আলু দিয়ে চিপস তৈরি হলেও তেমন স্বাদ হয় না। বাজার থেকে প্রতিমণ আলু ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায় কেনা হয়। সেই আলু সিদ্ধ করার পর গোলাকার করে কেটে রোদে শুকিয়ে ভেজে চিপস তৈরি করা হয়।
তিনি বলেন, পাঁচ মণ কার্ডিনাল আলুর এক মণ চিপস হয়। প্রতি মণ চিপস সাড়ে চার হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। মহাজনরা এসে আলুর চিপস নিয়ে যান। আবার তারা ঢাকা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন।
লুৎফর রহমান আরও বলেন, এই চিপস তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম হয়। তবে কারোরই লোকসান হয় না।
শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই এই আলুর চিপস তৈরির কাজ করেন। এক মৌসুমে হাজার-হাজার মণ কার্ডিনাল আলুর চিপস তৈরি করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এই আলুর চিপস তৈরির কাজ চলে। গ্রামের সবাই আলু চিপস তৈরির কাজ করে সারাবছর সংসার চালান।
স্থানীয় বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের গ্রামটি আলু ভাজার গ্রাম বলেই অনেক আগে থেকে পরিচিত। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই এই আলুর চিপস তৈরির ব্যবসা করেন। প্রতিবছর এখানে হাজার হাজার মণ আলুর চিপস তৈরি হয়।
৫৫ মণ আলু কিনে চিপস তৈরি করেছেন সানোয়ার হোসেন। এক মণ শুকানো চিপস তৈরি করতে তার দুই হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সময় লাগে দুইদিন। আর এক মণ চিপস বাজারে পাইকারি বিক্রি হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা। দুইদিনে লাভ হয় দেড় হাজার টাকা। আর তেলে ভেজে হাতে বিক্রি করলে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা লাভ হয়। সাধারণত তিনি তেলে ভেজে হাতে বিক্রি করেন।
আলু চিপসের কারিগর আ. রহিম জাগো নিউজকে বলেন, চিপস সংরক্ষণ করার জন্য এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আলু কিনতে হয়। সরকার যদি আমাদের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে উপকার হয়। তিনি এবার প্রায় এক হাজার মণ আলুর চিপস তৈরি করেছেন বলেও জানান।
আক্কেলপুর পৌরসভার মেয়র মো. শহিদুল আলম চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে আলুর চিপস তৈরির ফলে খাদ্য হিসেবে আলুর বহুবিধ ব্যবহার হচ্ছে। সরকার যদি এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত পরিবারগুলোকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দেয়, তাহলে এসব পরিবার গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখবে।
আক্কেলপুর উপজেলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আলুর বহুবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে আলু চাষিদের উৎপাদিত আলুর ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত হবে।
জয়পুরহাট বিসিকের উপ-পরিচালক লিটন চন্দ্র ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, আক্কেলপুর শহরের শ্রীকৃষ্টপুর গ্রামে যে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে তারা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমরা তাহলে তাদের সহজ শর্তে লোন দেওয়ার চেষ্টা করবো।
এমআরআর/এমএস