উপকরণের দাম বৃদ্ধি
লাভ করতে পারছেন না জুতা কারখানার মালিকরা
উপকরণের দাম বৃদ্ধিতে উৎপাদিত জুতার নায্যমূল পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। তাদের অভিযোগ একটি মহল জুতা তৈরির উপকরণ আমদানি করে বাজারে সংকট দেখিয়ে কারখানার মালিকদের কাছে বাড়তি দামে বিক্রি করছে। এতে জুতা তৈরিতে বাড়তি খরচ পড়ছে। কিন্তু বাড়তি খরচে জুতা তৈরি করে লাভ করা যাচ্ছে না বলে দাবি ভৈরবের জুতা তৈরির কারখানার মালিকদের।
ভৈরবের জুতা তৈরির কারখানাগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রাত-দিন সমান তালে কাজ করছেন কারখানার কারিগররা। অন্য সময়ের তুলনায় কারখানাগুলোতে ঈদের মৌসুমে কাজের চাপ থাকে কয়েকগুণ বেশি।
কিশোরগঞ্জ জেলায় ভৈরব একটি বাণিজ্যিক শহর। ১৯৮৬ সালের দিকে ভৈরবে জুতা তৈরির কারখানার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ছোট বড় মিলে এখানে ৮-১০ হাজার জুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয় আধুনিক যন্ত্রের কারখানা রয়েছে ৫০টি। এসব কারখানায় প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এছাড়া কারখানায় উৎপাদিত জুতা সারা দেশে বাজারজাত করার জন্য ভৈরবে রয়েছে পাঁচ শতাধিকের বেশি পাইকারি দোকান। এসব দোকান থেকে দেশের ৬৪ জেলার জুতার পাইকারি বিক্রেতারা তাদের পছন্দ মতো জুতা কিনে নিয়ে যান। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট ও ঢাকাসহ দেশের সবকটি জেলার পাশাপাশি বিদেশেও ভৈরবের উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা হচ্ছে।
সজীব স্যান্ডেল ফ্যাক্টরিতে জুতার আপার তৈরিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ৮-১০ জন নারী শ্রমিক। তাদের মধ্যে ময়না বেগম বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এ বছর ঈদ সিজনে কারখানায় কাজের চাপ অনেকটায় কম। তবে সরঞ্জামের দাম বাড়ার কারণে কারখানার মালিকরা তাদের উৎপাদিত জুতা বাড়তি দামে বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না। আর সেই প্রভাব আমাদের শ্রমিকদের ওপর পড়ছে। তারা আমাদের বাড়তি মজুরি দিচ্ছেন না।
আরেক শ্রমিক রুবেল মিয়া বলেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের মজুরি বাড়েনি। স্বল্প মজুরি দিয়ে দ্রব্যমূল্যের বাড়তি বাজারে পরিবার নিয়ে জীবনযাপন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখন এক প্লেট ভাজির দাম ১৫ টাকা, একটি পরোটা ১৫ টাকা। কিন্তু আগে ছিল ৫ টাকা। যে পরিস্থিতি হয়েছে জুতার কাজ করে সংসার চালানো কঠিন। মহাজনদের কাছে বাড়তি মজুরি চাইলে তারা বলে বাড়তি দামে জুতা তৈরি করে মার্কেটে বেশি দামে বিক্রি করতে পারছে না, তাই আমাদের বাড়তি মজুরিও দিচ্ছে না।
কারখানার কর্মচারী মিষ্টু মিয়া বলেন, রোজা শুরুর আগেই জুতা তৈরির কারখানাগগুলোতে বেশি চাপ বেশি থাকে। রোজায় তেমন বেশি চাপ থাকে না। এ বছর জুতার সরঞ্জামের দাম বাড়ার কারণে কারখানার মালিকরা তেমন লাভ করতে পারছেন না। এক ডজন জুতা তৈরিতে খরচ পড়ছে ৫০০ -৭০০ টাকা কিন্তু বাজারে দোকানিরা সেই জুতার দাম ২০০ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্বল্প পরিমাণ মুনাফা দিয়ে কারখানা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভৈরব হাজী মার্কেটের পাইকারি জুতা ব্যবসায়ী ‘টপ সুজ’র মালিক জিয়া রহমান বলেন, জুতায় ব্যবহৃত একটি পাথরের দাম ছিল ৩০ টাকা, সেটির দাম বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। জুতা তৈরির সরঞ্জামের দাম বাড়ার কারণে কারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু আমরা বাড়তি দামে উৎপাদিত জুতা বিক্রি করতে পারছি না। এই পাইকারি বাজারে দেশের সব জায়গা থেকে ক্রেতারা জুতা কিনতে আসেন। এ বছর বাজারে চায়না জুতার প্রভাবে দেশীয় উৎপাদিত জুতার চাহিদা কিছুটা ঘাটতি পড়েছে। পাইকারি মার্কেটে সাধারণত রোজার আগের মাস থেকে শুরু করে ২০ রোজা পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জায়গার ক্রেতারা জুতা কিনতে আসেন। কিন্তু এবছর দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার প্রভাবে আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারিনি।
হবিগঞ্জ জেলা থেকে আগত জুতার পাইকারি ব্যবসায়ী মো. মাহবুব মিয়া জানান, ভৈরবের উৎপাদিত জুতা খুব মজবুত, টেকসই ও উন্নতমানের হওয়ায় দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেজন্যই বিভিন্ন সিজনে ভৈরবের পাইকারি মার্কেট থেকে জুতা কিনে নিয়ে আমরা খুচরা বিক্রি করি।
ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সবুজ মিয়া জানান, জুতা ব্যবসায় গত তিন বছর মহামারি করোনার কারণে যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, এ বছর আমাদের আশা ছিল গত তিন বছরের ঘাটতি পূরণ করে লাভের মুখ দেখবো। কিন্তু সরঞ্জামের বাড়তি দাম সেটা আর হতে দিলো না। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুতা তৈরির উপকরণের দামও দ্বিগুণ বেড়েছে। কিছু ব্যবসায়ী তাদের দোকানে জুতা তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বাড়তি দামে কারখানার মালিকদের কাছে কাঁচামাল বিক্রি করছেন। প্রতিদিনই তারা কারখানার মালিকদের জিম্মি করে সরঞ্জামের দাম দ্বিগুণ বাড়িয়ে বিক্রি করছেন। আমরাতো আর প্রতিদিন দোকানিদের কাছে দাম বাড়িয়ে জুতা বিক্রি করতে পারি না। সে হিসাবে বাড়তি দামে সরঞ্জাম কিনে জুতা তৈরির খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু বাজারে হোল সেলস দোকানে বাড়তি দামে জুতা বিক্রি করতে পারি না। দাম বাড়ালে তারা জুতা নিতে চায় না ক্রেতা। এবছর জুতার গুণগত মান অনেক ভালো।
তিনি বলেন, সরকারের কাছে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি যেন নজর দেয়। তারা যেন জুতা কারখানার মালিকদের জিম্মি করে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে পাদুকা সরঞ্জাম বিক্রি না করতে পারে এবং পাদুকা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেন তিনি।
এফএ/জেআইএম