দিনাজপুরে প্রতি বছর ৭-৮ ফুট নিচে নামছে পানির স্তর
দিনাজপুরে ক্রমেই নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। জেলায় কমছে বৃষ্টিপাত। এতে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ ফুট নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। কোনো কোনো এলাকার মানুষ পানির অভাবে ঠিকমতো গোসল করতে পারছে না। পুকুর-ডোবাগুলো শুকিয়ে চৌচির। বড় দু-একটি নদী ছাড়া ছোট নদী শুকিয়ে গেছে।
অপরদিকে ডিজেলচালিত শ্যাল মেশিন ও বিদ্যুৎচালিত মোটর পাম্পে (সেচ পাম্প) পানি না ওঠায় বোরো ও ভুট্টাক্ষেতে পানি সেচ দেওয়ার জন্য কুয়ার মতো ১৫ থেকে ২০ ফুট গর্ত করে নিচে নামানো হচ্ছে। এতে প্রায়ই ঘটছে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা।
দিনাজপুরে লক্ষণীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। দিনে প্রচণ্ড গরম ও ভোরের আকাশে কুয়াশা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের জন্য ভূগর্ভস্থ থেকে অপরিকল্পিত পানি উত্তোলনকেই দায়ী করছেন পরিবেশবাদী ও সচেতন মহল। এছাড়াও বৃষ্টিপাত কমে যাওয়াও অন্যতম কারণ।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রতি ১০ বছরে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর প্রায় ১০-১৫ ফুট নিচে নামছে। ৩০ বছর আগে যেখানে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ৩০ ফুটে, এখন সেখানে অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ৮০ থেকে ৯০ ফুট অথবা তার চেয়েও বেশি গভীরে।
জানা গেছে, ১৯৮৫ সালের ক্ষরা মৌসুমে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর ছিল গড়ে ২০ ফুট ৬ ইঞ্চি, ১৯৯৫ সালে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় ৩০ ফুটে। ২০১০ সালে পানির স্তর নেমেছে ৬৬ ফুটে। ২০১৯ সালে দিনাজপুর জেলায় পানির স্তর নেমে দাঁড়িয়েছে ১৩৫ ফুটে। ২০২৩ সালে এসে সেটা প্রায় দেড়শো ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় কৃষক ধান উৎপাদনে চরম সংকটে পড়েছেন।
দিনাজপুরের সদর, বিরল, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, কাহারোল, চিরিরবন্দর, খানসামা ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এসব উপজেলায় পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ডিজেলচালিত শ্যাল মেশিন ও বিদ্যুৎচালিত মোটরগুলো পানি টেনে তুলতে পারছে না। এতে কৃষকরা বাধ্য হয়ে শ্যাল মেশিন ও মোটরগুলো কুয়ার মতো ১৫ থেকে ২০ ফুট গর্ত করে নিচে নামিয়েছেন। টিউবওয়েলগুলোতেও পানি উঠছে না।
বৈশাখ মাসে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে এ অবস্থা আরও তীব্র আকার ধারণ করবে। বর্তমানে দিনাজপুরে ৫০টি ইউনিয়নের মানুষ সুপেয় পানির অভাবে রয়েছে। এসব ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে পানির জন্য তীব্র হাহাকার। অনেক এলাকায় চাষাবাদ তো দূরের কথা, মানুষের খাবার পানি পাওয়াও দুষ্কর হয়ে গেছে।
শনিবার সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার ৫নং শশরা ইউনিয়নের কাশিপুর, বইরাগিডিঘি, ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের মহিষকোঠা ও ৯নং আস্করপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর এলাকায় শতশত ডিজেলচালিত শ্যাল মেশিন ও বিদ্যুৎচালিত মোটর ১৫ থেকে ২০ ফুট গর্ত করে নিচে নামনো দেখা যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কৃষকরা গর্তের মধ্যে নেমে সেই শ্যাল ও মোটরগুলো চালাচ্ছেন। এতে করে ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক সময় গর্তে পানি জমে বিদ্যুতায়িত হয়ে অনেকের মৃত্যু ঘটছে। গর্তগুলো যেন কৃষকের মৃত্যুফাঁদ।
একই অবস্থা বিরল, বোচাগঞ্জ, বীরগঞ্জ, কাহারোল, খানসামা, চিরিরবন্দর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
এ ব্যাপরে জানতে চাইলে ৫নং শশরা ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের জাহিদ হোসেন, ৬নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের কৃষক আজির উদ্দিন ও ৯নং আস্করপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের রাকিব হাসান জানান, মেশিনগুলো বাধ্য হয়ে গর্তে নামানো হয়েছে। বিকল্প ব্যবস্থায় পানি রিজার্ভ করে রাখা গেলে পানি যেমন সহজেই পাওয়া যাবে, তেমনি কৃষিতে সেচ খরচও কমে যাবে। গোসল করার মতো পানি নেই। কেউ শ্যালো মেশিন চালালে সেখান থেকে গোসল ও ওযুর পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
বীরগঞ্জ উপজেলার ৭নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাহানপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্যামল কর্মকার বলেন, প্রায় ৪ মাস থেকে আমাদের এলাকায় টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। যাদের বাসায় সাবমার্সিবল আছে তাদের বাড়ি থেকে অথবা ধান-ভুট্টাক্ষেতের শ্যাল ও মোটর যখন চালুর করে তখন সেখান থেকে পানি নিয়ে এসে সংসারের প্রয়োজনীয় কাজ সারছি।
পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলের দাবি, নদী, বিল, ঝিল, খাল, ডারা, নয়নজলিগুলোতে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা এবং অপরিকল্পিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করা গেলেই কেবল এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। অন্যথায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়তে হবে দিনাজপুরের মানুষকে।
দিনাজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী এ এন মো. নাইমুল এহসান বলেন, আপাতত জনগণকে টিউবওয়েল বসানোর ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে সাবমার্সিবল, শ্যাল ও তারা পাম্প বসানো হচ্ছে। দিনাজপুর জেলার ১৩টি উপজেলায় মোট ১০২টি ইউনিয়ন রয়েছে। চলতি বছরে ১০টি সাবমার্সিবলসহ ২৩শো শ্যাল ও তারা পাম্প বসানোর কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি বলেন, গড়ে প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ ফুট পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
এফএ/এমএস