কুষ্টিয়ার বক্ষব্যাধি ক্লিনিক যেন নিজেই রোগী
দুজন চিকিৎসকের বিপরীতে বছরের পর বছর দায়িত্ব পালন করছেন একজন মাত্র চিকিৎসক। এক্সরে করার জন্য একটি এনালগ মেশিন থাকলেও রেডিওগ্রাফার পদে লোক না থাকায় বন্ধ সেটি। ১৭টি পদের বিপরীতে লোকবল আছে ১২ জন। একমাত্র ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি স্থাপন করার পর থেকেই বিকল। যক্ষা রোগ শনাক্তের জন্য অপরিহার্য একমাত্র জিন এক্সপার্ট মেশিনটিও নষ্ট। এমনকি ভবনটিও রুগ্ন। বর্ষা শুরু হলেই প্রবেশ পথে এমনকি ক্লিনিকের ভেতরে হাঁটুপানি জমে।
যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার কারণে চিকিৎসকসহ স্টাফরা রুটিন মাফিক অফিসে এলেও গল্প-গুজব করেই সময় কাটান। এমন অবস্থায় রোগ শনাক্ততো দূরের কথা নিজেই মুমূর্ষু রোগীতে পরিণত হয়েছে কুষ্টিয়া শহরের কাটাইখানা মোড়ে অবস্থিত সরকারি বক্ষব্যাধি ক্লিনিক।
জানা যায়, ১৯৬০ সালে শহরের সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন রোড (কাটাইখানা মোড়) এলাকায় কুষ্টিয়া বক্ষব্যাধি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়।
সরেজমিনে বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায়, বহু আগের তৈরি একতলা ক্লিনিক ভবনটি বর্তমানে একবারেই রুগ্ন হয়ে পড়েছে। ভবনটি বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপোযোগী এবং কোনো অবস্থাতেই রোগীবান্ধব নয়।
ক্লিনিকে কর্মরত মেডিকেল অফিসার ডা. শারমিন আক্তার জানান, বর্তমানে এখানকার জিন এক্সপার্ট মেশিনটি নষ্ট থাকায় যক্ষা রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না। মেশিনটি ২০১৩ মডেলের। ওই বছরই এটি স্থাপন করা হয়। স্থাপন করার পরপরই একের পর এক মেশিনটির মডিউলার নষ্ট হতে থাকে। মাত্র একটি সচল মডিউলার দিয়ে কাজ চলছিল। সেটিও গত ২-৩ মাস ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
তিনি জানান, এখানে একটি এনালগ এবং একটি ডিজিটাল এক্সরে মেশিন রয়েছে। প্রায় এক বছর আগে ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি স্থাপন করা হয়। কিন্তু স্থাপন করার পর থেকেই এটি নষ্ট অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এনালগ এক্সরে মেশিনটি সচল থাকলেও রেডিওগ্রাফার পদে লোক না থাকায় প্রায় ৪ মাস যাবৎ এক্সরে বন্ধ। নিয়ম মেনে আমরা স্টাফরা ক্লিনিকে যাচ্ছি কিন্তু সেবা প্রত্যাশীদের সেবা দিতে পারছি না।
ক্লিনিক ভবনটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য কয়েক দফায় কুষ্টিয়া গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং এলজিইডি কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানান এই চিকিৎসক।
জানা যায়, বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে লোকবলের সংকট রয়েছে। ১৭টি পোস্টের বিপরীতে বর্তমানে এখানে ১২ জন কর্মরত। এর মধ্যে দুজন চিকিৎসকের বিপরীতে দীর্ঘদিন ধরে একজন দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৫ সালে এখানকার মেডিকেল অফিসার ডা. আসাদুজ্জামান ফিরোজ মাদক সংক্রান্ত মামলার কারণে বরখাস্ত হয়ে রয়েছেন। এরপর থেকে তার জায়গায় আর অন্য কাউকে পদায়ন করা হয়নি।
এদিকে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে যক্ষ্মা নির্মূলে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা সত্ত্বেও কুষ্টিয়ায় যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। তবে কর্তৃপক্ষের দাবি রোগ নির্ণয়ে শতভাগ নির্ভুল পদ্ধতি অবলম্বন এবং জনসচেতনা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জেলায় যক্ষ্মারোগী শনাক্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের গত ছয় বছরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলায় প্রতি বছরই যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
জেলার ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিগত ছয় বছরের যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত রুগীর সংখ্যা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে জেলায় যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা ছিল ৪১৬৪ জন। পরের বছর ২০১৮ সালে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৫৩৬ জন। ২০১৯ সালে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা ছিল ৪৮৬৮ জন। তবে ২০২০ সালে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৯৯৩ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২০ সালে যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়েও বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনা মহামারীর কারণে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হয়নি।
গত বছর কুষ্টিয়া জেলায় ২০২২ সালে রেকর্ড সংখ্যক ৪৩ হাজার ৬৭৯ জনের যক্ষ্মা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩২৬৯ জন যক্ষ্মা রোগী সনাক্ত হয়েছে। তার আগের বছর ২০২১ সালে ৪৬ হাজার ১৬৯ জনের যক্ষ্মা পরীক্ষা করা হয়। শানাক্ত হয় ৪৯৮৪ জন। আর চলতি বছর ২০২৩ সালের প্রথম দুই মাসে ৮৩৭০ জনের পরীক্ষার বিপরীতে যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৬৯৫ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগের প্রদত্ত তথ্য মতে, কুষ্টিয়া জেলার ৬টি উপজেলার মধ্যে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যা এক সময় সবচেয়ে বেশি ছিল দৌলতপুর উপজেলায়। এরপর কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, ভেড়ামারা ও কুমারখালী উপজেলায়। আর সবচেয়ে কম যক্ষ্মারোগী রয়েছে খোকসা উপজেলায়। তবে বিগত দুই-তিন বছর ধরে দৌলতপুর উপজেলার চেয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত বেশি হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এএইচএম আনোয়ারুল ইসলামের মতে, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ছে। মানুষ এখন একটু কিছু হলেই চিকিৎসকের কাছে ছুটে আসছে। স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে যক্ষ্মারোগী শনাক্তের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার হারও বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে অত্যাধুনিক জিন এক্সপার্ট মেশিনের সাহায্যে যক্ষ্মারোগী শনাক্তের শতভাগ নির্ভুল পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে।
এফএ/জিকেএস