রমজানে বেচাকেনা হবে কোটি টাকার গিগজ মুড়ি
রমজান ঘিরে চাহিদা বেড়েছে লক্ষ্মীপুরে উৎপাদিত হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির। স্বাদে-ঘ্রাণে অনন্য ঐতিহ্যবাহী এ মুড়ি স্থানীয়দের কাছে বেশ জনপ্রিয়। কোনো কেমিক্যাল ছাড়াই লবণ পানি দিয়ে এ মুড়ি ভাজা হয়। ইফতারে গিগজ মুড়ি লক্ষ্মীপুরের প্রায় প্রতিটি পরিবারের পছন্দের তালিকায় থাকে। লক্ষ্মীপুরের পাশাপাশি আশপাশের জেলা ও মধ্যপ্রাচ্যেও ছড়িয়েছে এ মুড়ির সুনাম।
সূত্র জানায়, জেলায় প্রতি বছর ৫০০ টনেরও বেশি গিগজ মুড়ি উৎপাদিত হয়। তাও সম্পূর্ণ হাতে ভাজা। এতে বছরে প্রায় ৮ কোটি টাকার মুড়ি বেচাকেনা করেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। তবে শুধু রমজান মাসেই কোটি টাকার মতো লেনদেন হয় বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন- ক্ষুদ্র শিল্পের স্বীকৃতি পেল সুপারির খোলে তৈরি নান্দনিক তৈজসপত্র
লক্ষ্মীপুরের চাহিদা মিটিয়ে এ মুড়ি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও এ মুড়ি রপ্তানি হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে উদ্যোক্তারা ১৩০-১৪০ টাকা কেজি দরে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন এই গিগজ মুড়ি। ব্যবসায়ীরা ১৫০-১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। এ মুড়ির বর্তমান বাজার মূল্য ১৬০ টাকা বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর সদর মডেল থানা রোডের ব্যবসায়ীরা।
এদিকে অধিক মূল্যে গিগজ ধান ক্রয়সহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি শিল্পটি হুমকির মুখে পড়েছে। আর্থিক সংকটে উদ্যোক্তা কমে যাচ্ছেন। সরকারি প্রণোদনা পেলে এ শিল্পটি আরও বেগবান করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা। একই সঙ্গে এ শিল্প ঘিরে জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাচীনকাল থেকেই হাতে ভাজা গিগজ ধানের চালের মুড়ি সারা দেশে বিখ্যাত। তবে কয়েক বছর ধরে ধানের বিলুপ্তি ও মেশিনে ভাজা মুড়ির আধিপত্যের কারণে হাতে ভাজার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ধানের দাম বেড়ে যাওয়ায় মুড়ি উৎপাদনে খরচ বেশি হচ্ছে । শ্রম অনুযায়ী মুড়িতে এখন লাভ নেই বললেই চলে। এতে দিন দিন উদ্যোক্তা কমে যাচ্ছে। আর ভাটা পড়ছে শিল্পটিতে। এক সময় এক হাজার টনেরও বেশি মুড়ি এ জেলায় উৎপাদন হতো। বর্তমানে প্রায় ৫০০ টন মুড়ি উৎপাদন হয় এ জেলায়।
আরও পড়ুন- গল্পটা সংগ্রামী শিউলির
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলা সদর, রায়পুর, কমলনগরসহ বিভিন্ন এলাকার শতাধিক পরিবার এ মুড়ি উৎপাদনে জড়িত। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই তারা এখনো মুড়ি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একই সঙ্গে বিশ্ববাজারেও পৌঁছে দিচ্ছেন সুস্বাদু এ মুড়ি। এই মুড়ি দেশ-বিদেশে জেলার ব্র্যান্ড হিসেবেও পরিচিত বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ জেলায় এক সময় গিগজ ধানের চাষাবাদ বেশি ছিল। বর্তমানে গিগজ ধানের উৎপাদন বিলুপ্তির পথে। জেলা সদরের মজুচৌধুরীর হাট, রায়পুরের চরবংশী, মোল্লারহাট, কমলনগরের তোরাবগঞ্জ বাজার, উত্তর মার্টিন বাজার, মতিরহাট, করুণানগর, রামগতি বাজার ও আড়তে গিগজ ধান কেনাবেচা হয়। গিগজ ধানের পাশাপাশি একই মানের ভুসিহারা, ধলামোডা জাতের দেশীয় ধান থেকেও এ মুড়ি তৈরি হয়।
লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সমসেরাবাদ, উত্তর মজুপুর, বেঁড়িরমাথা, কমলনগর উপজেলার করুণঅনগর, দক্ষিণ গ্রাম, উত্তর গ্রাম, চর জাঙ্গালিয়া, রামগতি উপজেলার চর ডাক্তার এবং রঘুনাথপুর হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির জন্য বিখ্যাত। আটটি গ্রামের শতাধিক পরিবারের প্রধান জীবিকা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি।
লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সমসেরাবাদ এলাকার জোড় দিঘিরপাড় এলাকায় প্রায় ৩০টি পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন করে।
সম্প্রতি সেখানে কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, ধান ক্রয়ের পর শুকানো থেকে শুরু করে চাল সংগ্রহও তাদের করতে হয়। প্রতিদিন রাত ৩টা থেকে তারা মুড়ি ভাজার কাজ শুরু করেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত এক নাগাড়ে মুড়ি ভাজেন। আশপাশের নারী শ্রমিকরা এ কাজে নিয়োজিত। এ মুড়ি ভাজতে কোনো কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। শুধু লবণ পানি দিয়ে চাল ভিজিয়ে মুড়িগুলো ভাজা হয়। প্রতিদিন মুড়ি ভাজতে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের।
সমসেরাবাদ এলাকার সরকার বাড়ির মুড়ি শিল্পের কারিগর ও উদ্যোক্তা বাবুল দাস এবং কমলনগরের মুসলিমপাড়ার কানোজিৎ রঞ্জন দাস জানান, অত্যন্ত কষ্টকর হলেও বংশগতভাবেই তারা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। এক সময় হাতে ভাজা মুড়ির দখলে ছিল স্থানীয় হাটগুলো। এখন মেশিনে ভাজা মুড়িতে সয়লাব হওয়ায় হাতে ভাজা মুড়ির উৎপাদন কমে গেছে। বর্তমানে সঠিক মূল্য পাওয়া যায় না। সরকারিভাবে ঋণ কিংবা অন্য কোনোভাবে তাদের সহায়তা করা হচ্ছে না। দিন দিন ধানের মূল্যবৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পেশার সঙ্গে জড়িত থাকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন- মুজিব কিল্লার পুকুর থেকে অবৈধভাবে বালু তুলছেন ইউপি সদস্য
সদর মডেল থানা রোডের ব্যবসায়ী শম্ভু দাস ও মানিক চন্দ্র দাস জানান, মেশিনে ভাজা গিগজ মুড়ি ও অটো মুড়িতে বাজার সয়লাব। দাম কম হওয়ায় অটো মুড়ি বেশি বেচাকেনা হচ্ছে। এতে হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির বিক্রি কমে যাচ্ছে। তবে স্থানীয়দের মধ্যে এখনো হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির চাহিদা বেশি। হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি খান, তারা অন্য মুড়ি মুখেই তোলেন না। দাম বেশি হলেও হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি দোকানে রাখতেই হয়। মাঝে মাঝে কয়েকজন ঢাকার রপ্তানিকারক মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকায় এই মুড়ি রপ্তানি করেন।
লক্ষ্মীপুর বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মো. মাকছুদুর রহমান বলেন, মুড়ি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় প্রকল্প। আমাদের অধীনেও মুড়ি উৎপাদন কারখানা রয়েছে। করোনাকালীন আমরা প্রণোদনার মাধ্যমে সহজশর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেছি। এখনো গুচ্ছ পদ্ধতিতে তাদের ঋণসহায়তা দেওয়া হয়।
এফএ/এমএস