আধুনিকতার ছোঁয়ায় আগ্রহ বাড়ছে মৃৎশিল্পে
শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পের দেশব্যাপী সুখ্যাতি দীর্ঘদিনের। দেশ ছেড়ে এখানকার পণ্য এখন ২৫ দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পণ্যের ভিড়ে ছিটকে পড়েছে মৃৎশিল্পের অধিকাংশ দৈনন্দিন পণ্যের চাহিদা। তাই প্রাচীনকালের এই ব্যবসার উদ্যোক্তাও দিন দিন কমে আসছে।
প্রাচীনকাল থেকে জেলার পাল বংশের মানুষ গৃহস্থালির বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরি করছেন। বর্তমানে আদি এই পেশায় এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। মানুষ এখন মাটির তৈরি বিভিন্ন পণ্য শৌখিনতায় বেশি ব্যবহার করছে। তাই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন পণ্য, যা শুধু দেশেই নয়, যাচ্ছে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্সের মতো দেশে।
আগে গৃহস্থালি কাজের জন্য মাটির থালা-বাসন, কলস, হাঁড়ি, পাতিল, বদনা, মটকাসহ অনেক তৈজসপত্র তৈরি হতো। বর্তমানে প্লাস্টিক, মেলামাইন ও ধাতব পণ্যের ভিড়ে ছিটকে পড়ছে এসব পণ্যের চাহিদা। তবে পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে ও নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মৃৎশিল্পে এসেছে পাল বংশের নতুন প্রজন্মও।
সরেজমিনে দেখা যায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার রামভদ্রপুর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে উত্তম পাল (৫৫) মাটি দিয়ে খেলনা পুতুল তৈরি করছেন। তার পাশেই ছোট ভাই সুব্রত পাল মাটি দিয়ে ছবির ফ্রেম তৈরি করছেন। তাদের রয়েছে মাটির জন্য অন্যরকম এক ভালোবাসা। এই কাজের উপার্জন দিয়েই তাদের সংসার চলে।
একই সময় দেখা গেলো ঢাকায় পাঠানোর জন্য বিভিন্ন পণ্য ট্রাকে লোড করছেন শ্রমিকরা। প্রথমে মাটির তৈরি এসব পণ্য ঢাকার বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্ট হ্যান্ডিং ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে নেওয়া হবে। সেখান থেকে ইনপুট করা হবে ইউরোপের নানা দেশে।
কারিগররা শহুরে জনগোষ্ঠী আর বহির্বিশ্বের চাহিদা মাথায় রেখে নিত্যনতুন নকশাও করছেন। শুধু গৃহস্থালির পণ্যই নয়, তারা তৈরি করছেন ফুলদানি, মোমদানি, কলমদানি, হারিকেন, পুতুল, সাইকেল, ফলের ট্রে, আকর্ষণীয় টালিসহ নানা রকমের শোপিস।
নারী-পুরুষ কাজ করছেন সমান তালে। কেউ মাটি প্রস্তুত করছেন, কারও দৃষ্টি নিপুণ নকশায় কেউবা পণ্য পোড়ানোর কাজে ব্যস্ত। পণ্যের গায়ে রঙতুলির আঁচড় বসাতে ব্যস্ত অনেকে। রঙের পরশ বুলানোর পর একদল পণ্যগুলো প্যাকেটজাত করছে। এ যেন এক ব্যস্ত কর্মযজ্ঞ।
এদিকে মাটির তৈরি এসব পণ্য পরিবেশবান্ধব হওয়ায় ক্রেতাদের আগ্রহ আবার বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার অন্তত ২৫টি দেশে এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।
কাজের ফাঁকে উত্তম পাল বলেন, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রেখে এখনও এই কাজ করছি। তবে এই কাজ করেই প্রতিবন্ধী ছেলেকে বিসিএসের পড়ালেখা করাচ্ছি। মাটির তৈরি পণ্যের প্রতি সরকার কোনো আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাহায্য করছে না। বর্তমানে আমাদের দেশ থেকে বিদেশে মাটির তৈরি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে বিদেশে এই মাটির জিনিসপত্রে আধুনিক মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সেদিক থেকে ১০০ বছর পিছিয়ে।
সুব্রত পাল বলেন, মৃৎশিল্পে সরকারিভাবে কেউ সাহায্য করে না। আমরা এক হাজার টাকার পণ্য উৎপাদন করলে মাত্র ২০০ টাকা লাভ হয়। কিন্তু হাতে তৈরি করায় উৎপাদন কম, তাই লাভও কম। যদি যন্ত্রের সাহায্যে মাল বানাতে পারতাম তাহলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেতো, লাভও বেশি হতো।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান বলেন, শরীয়তপুরের মৃৎশিল্পের পণ্যগুলো আমি অনেকবার দেখেছি। সেখানকার মুনাফা মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটেই যাচ্ছে। মৃৎশিল্পীরা যাতে ন্যায্যমূল্য পান, সেজন্য উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে সরাসরি পণ্য কেনাবেচার কাজ চলছে। উদ্যোক্তাদের ই-কমার্স সাইটের মাধ্যমেও পণ্যগ তুলে ধরা হবে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারও সম্প্রসারিত হবে। মৃৎশিল্প শরীয়তপুরের ঐতিহ্য। আন্তর্জাতিকভাবে এর নতুন বাজার সৃষ্টি করতে সরকার কাজ করছে।
এফএ/এএসএম