বাল্যবিয়েও থামাতে পারেনি শাপলাকে
এসএসসির গণ্ডি পেরোনোর আগেই যার সব ইচ্ছাকে বলি দিয়ে বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে, তিনিই এখন পথ দেখাচ্ছেন হাজারো নারী উদ্যোক্তাকে। পেশায় একজন মাদরাসা শিক্ষক হয়েও নিজের সর্বোচ্চ মেধা আর শ্রম দিয়ে পিছিয়েপড়া নারীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে সদর উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানও তিনি। এর আগে শেরপুর জেলায় শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে জয়িতা নির্বাচিত হয়েছেন সাবিহা জামান শাপলা।
স্বামী, সন্তান আর সংসার সামলে কীভাবে একজন সফল দিকনির্দেশক হওয়া সম্ভব, সে গল্পই তিনি শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে।
সাবিহা জামান শাপলার জন্ম শেরপুর সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়নের নলবাইদ গ্রামে। বাবা সুরুজ্জামান পেশায় একজন শিক্ষক, মা মোমেনা খাতুন গৃহিনী। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবা স্কুল শিক্ষক হওয়ার সুবাদে পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবার স্কুলেই। কখনো বাবার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে আবার কখনো তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটে একই স্কুলে পড়ুয়া বড় বোনের সঙ্গে যাতায়াত করতেন তিনি।
স্কুল থেকেই নাচের প্রথম পুরস্কারের দখল ছিল তার ঝুলিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষায় ওই ইউনিয়ন থেকে বৃত্তি লাভ করায় ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার কথা বিবেচনা করে পুরো পরিবার নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে ভাড়া বাসায় ওঠেন তার বাবা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তির পাশাপাশি নৃত্য শেখার জন্য ভর্তি হন শিল্পকলা একাডেমিতে। প্রতিবেশী সমালোচকদের নানা টিপ্পনীতে হঠাৎ করেই নৃত্য বন্ধ করে দেন মা মোমেনা খাতুন। এ যেন স্বপ্ন ভঙ্গের আরেক ধাপ। কিছুদিন বন্ধ থাকার পরে কখনো মাকে বুঝিয়ে আবার কখনো বাবার অনুমতি নিয়ে মায়ের অজান্তে লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে থাকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ।
১৯৯৩ সালে তিনি যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, এসএসসি পরীক্ষার দুইমাস আগে অনেকটা জোর করেই হঠাৎ পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়ে যায় বিদেশফেরত এক যুবকের সঙ্গে। পরবর্তীকালে শ্বশুর ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্বা আবুল কাশেমের অনুপ্রেরণায় ওই বছর এসএসসি পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর কলেজে পড়ার সময় তিনি শিশু একাডেমি ও পাতাবাহার খেলাঘর আসরের নৃত্যের প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এই অবস্থায় প্রথম সন্তান সাকিব উল ইসলামের জন্ম হলে বেড়ে যায় দায়িত্ব।
পরবর্তীকালে ১৯৯৫ সালে দ্বিতীয় বিভাগে এইচএসসি ও ১৯৯৭ সালে বিএ পাস করেন। এরপর তার কোলে আসে দ্বিতীয় সন্তান সিফাত উল ইসলাম। ফলে আরেক দফা বেড়ে যায় দায়িত্ব। ওই সবকিছু মোকাবিলা করেও তিনি ২০০০ সালে এমএ ও ২০০৩ সালে বিএড পাস করেন। পরে বিদেশফেরত স্বামীর পরামর্শে সিদ্ধান্ত নেন একটি বিউটি পার্লার খোলার। ২০০৬ সালের দিকে শহরের নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে তোলেন প্রিয়াঙ্গণ হারবাল বিউটি পার্লার। মুসলিম পরিবারের মেয়ে হয়ে ওই বিউটি পার্লার চালাতে গিয়েও নিন্দুকদের সস্তা সমালোচনাসহ পোহাতে হয় অনেক ঝামেলা। কিন্তু হার না মানা শাপলা শক্ত হাতে সেই পার্লার চালিয়ে যাওয়ার কারণে ঘুরে যায় তার সংসারের চাকা। স্বাবলম্বিতার পথে অগ্রসর হতে থাকেন শাপলা।
ওই অবস্থায় ২০০৮ সালের দিকে সাংবাদিকতার দিকে পা বাড়ান তিনি। নারী হওয়ার কারণে সেটিতেও নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হয় তাকে। এরপর ২০১০ সালের দিকে সাফল্যের আরেক অধ্যায়ে পা রাখেন শাপলা। জেলা সদরের একটি মাদরাসায় হয়ে যায় শিক্ষকতার চাকরি। একই সময়ে আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতিসহ শেরপুরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পরে ২০১৪ সালে তিনি শেরপুর প্রেস ক্লাবের কার্যনির্বাহী পরিষদের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি।
সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি জেলার পিছিয়ে পড়া নারীদের নিয়ে কাজ করছেন। নিজের বিউটি পার্লারে দরিদ্র নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও কাজের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। বর্তমানে তার বড় ছেলে বিজিএমইএ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন ও ছোট ছেলে এইচএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও শিক্ষকের পাশাপাশি তিনি জনপ্রতিনিধি। ২০১৯ সালে শেরপুর সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই পশ্চাদপদ ও পিছিয়ে পড়া দরিদ্র-মেধাবী কিশোরী, তরুণী ও নারীদের জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ভাতার ব্যবস্থা করেছেন তিনি।
সাবিহা জামান শাপলা জাগো নিউজকে বলেন, আমার চলার পথে বাবা ও স্বামীর সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি। তাদের প্রচেষ্টা আর অনুপ্রেরণায় আমি আজকের এই অবস্থানে। আমি স্বপ্ন দেখি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী থেকে নিজের শ্রম, মেধা, কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে সমাজের অসহায় নারীদের উন্নয়নে কাজ করে যাব। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চাই আমৃত্যু। সহযোগিতা চাই সমাজের সর্বস্তরের গণমানুষের।
এমআরআর/এএসএম