ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

কৃষি যন্ত্রাংশে বগুড়ায় নীরব বিপ্লব

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড় | প্রকাশিত: ০৮:১৪ এএম, ০৭ মার্চ ২০২৩

বগুড়া শহরে গড়ে উঠেছে অনানুষ্ঠানিক বিশাল এক শিল্পাঞ্চল। এখানকার শত শত কারখানায় তৈরি হচ্ছে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হরেক রকমের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। সেচকাজের সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প, পাওয়ার টিলার, ডিজেলচালিত ইঞ্জিন, রাইস মিল, টিউবওয়েল, ধান, গম, ভুট্টা মাড়াই মেশিন, চাল, হলুদ, মরিচ গুঁড়া করার মেশিন, লায়নার, পিস্টনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এখন বগুড়ায় তৈরি হচ্ছে। বগুড়ার তৈরি সেন্ট্রিফিউগাল পাম্প ভারত, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানিও হচ্ছে।

মূলত ১৯৮০ সালের দিকে বগুড়ার এ হালকা প্রকৌশল শিল্প ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। বগুড়া এগ্রো মেশিনারি ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড প্রসেসিং জোনের সভাপতি গোলাম আযম টিকুল বলেন, বগুড়ায় এরকম হাজারখানেক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় লক্ষাধিক মানুষ কাজ করছেন।

আব্দুল লতিফ নামের আরেক কারখানার মালিক জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ধানের মৌসুমে হাজার পিস যন্ত্র বিক্রি করি। বছরে আমার মোট বিক্রির পরিমাণ ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা।

jagonews24

আরও পড়ুন: ব্লাড ব্যাংকের রক্ত ভয়ংকর!

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার পাশে কৃষি মার্কেটে রয়েছে শ খানেক ছোট ছোট কারখানা, যেখানে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতি। বগুড়ায় এসব কারখানা পরিচিতি পেয়েছে হালকা প্রকৌশল শিল্প হিসেবে।

সূত্রাপুরে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক মমিন আলী তার কারখানায় পাওয়ার থ্রেশার বা ধান মাড়াইয়ের যন্ত্র তৈরি করেন। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা ছাড়াও দেশের অন্তত ২০ জেলায় তার এ যন্ত্র পাওয়া যায়। দামও মোটামুটি কম।

কৃষি মার্কেটে একটি কারখানার মালিক গোলজার রহমান জানান, তারাও ধান মাড়াই ও ধান কাটার মেশিন তৈরি করেন। ধানকাটা মেশিন দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় এক বিঘা জমির ধান কেটে ফেলা যায়।

jagonews24

‘কলের কাঁচি’ নামের এ যন্ত্রটি তৈরি করেছেন যন্ত্রবিজ্ঞানী আমির হোসেন। তার হাত ধরে তৈরি যন্ত্রটি এখন শহরের আনাচে-কানাচে অনেক স্থানেই তৈরি হচ্ছে। শুধু ধান নয়, কলের কাঁচি একইসঙ্গে গম, ভুট্টা, পাট ও আখ কাটতেও সিদ্ধহস্ত।

আরও পড়ুন: ‘ওঠাও বাচ্চা’তে সর্বস্বান্ত বগুড়ার মানুষ

কৃষি মার্কেটে গোটা পঞ্চাশেক কারখানায় একই ধরনের যন্ত্র তৈরি হচ্ছে। ফুটখানেক দৈর্ঘ্যের গোলাকৃতি একটি স্টিলের সিলিন্ডারসদৃশ যন্ত্র, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘লায়নার’। এটি মূলত সেচকাজে ব্যবহৃত শ্যালো ইঞ্জিনের একটি যন্ত্রাংশ। এরকমই একটি লায়নার তৈরির কারখানার মালিক মোহাম্মদ শাহিন বলেন, ‘সারাদেশ নিয়ন্ত্রণ করি আমরা বগুড়ার কারখানা মালিকরাই। ঢাকার ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছ থেকে মাল কেনেন। বরিশাল, খুলনা, যশোর থেকেও আমাদের কাছে কিনতে আসেন।’

শহরের রেলওয়ে কৃষিপণ্যের মার্কেটের বসাক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক বিশ্বজিৎ বসাক বলেন, ঢালাই কারখানায় পুরোনো লোহা ও ঢালাই গলানোর পর তা আগে তৈরি করা ছাঁচে ঢেলে জমানো হয়। পরে সেই জমানো লোহা তারা ওয়ার্কশপে ফিনিশিং করে বিক্রি করেন।

এ শিল্পের সঙ্গে চার শ্রেণির ব্যবসায়ী জড়িত। এক ধরনের ব্যবসায়ী যারা পুরোনো লোহা সংগ্রহ করেন। আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ী তা বেচাকেনা করেন। তৃতীয় ধাপে এসে তা গলিয়ে ফিনিশিং দিয়ে বাজারজাতের জন্য রয়েছেন আরেক ধরনের ব্যবসায়ী। সবশেষ এসব লোহা ওয়ার্কশপে নিয়ে তৈরি হয় যন্ত্রাংশ।

jagonews24

আরও পড়ুন: খরচ কাটাছেঁড়া করেও মিলছে না হিসাব

কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ কৃষি যন্ত্রপাতি এবং যন্ত্রাংশের ৭৫ শতাংশ চাহিদা মেটাচ্ছে বগুড়া। যার বার্ষিক বিপণন মূল্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি। সেইসঙ্গে ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে শহরের এ হালকা প্রকৌশল খাত। বগুড়ায় তৈরি এসব কৃষি যন্ত্রপাতি বিক্রির জন্য শহরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মার্কেট, যেখানে রয়েছে তিনশর বেশি বিপণন প্রতিষ্ঠান।

পার্শ্ববর্তী দেশেও বগুড়ায় তৈরি বেশকিছু যন্ত্রাংশ রপ্তানি হয় বলে জানান এখানকার ব্যবসায়ীরা। গুণগতমান ও দামে সহজলভ্য হওয়ায় অবাদে দেশের বাইরে যাচ্ছে এসব শিল্পপণ্য। প্রতি বছর এ খাতে বেচাকেনার অর্থ দেশের অর্থনীতিকে বেগমান রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে।

কৃষকদের মধ্যে বগুড়ার তৈরি কৃষিযন্ত্রের কদর কতটুকু তা দেখতে সম্প্রতি শহরের সাবগ্রাম এলাকার আব্দুল ফকির নামের একজন কৃষকের বাড়িতে যান এ প্রতিবেদক। তিনি তখন একটি ধান মাড়াই যন্ত্রে ক্ষেত থেকে সদ্য কেটে আনা ধান মাড়াই করছিলেন। তার ব্যবহৃত সেই যন্ত্রটি বগুড়ায়ই তৈরি।

এ কৃষক বলেন, একসময় তারা সনাতন পদ্ধতিতে ধান মাড়াই করলেও এখন যন্ত্র ব্যবহার করেই করেন। অন্তত তার পরিচিত কোনো কৃষককে এখন আর হাতে ধান মাড়াই করতে দেখেন না তিনি।

jagonews24

আরও পড়ুন: দিনাজপুরে কৃষির পালে হাওয়া, বদলে গেছে জেলে-জীবিকা

বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় গড়ে উঠেছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বা আরডিএ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সেখানে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে স্বনির্ভর করে তোলার উদ্যোগের পাশাপাশি নানা বিষয়ে গবেষণা করা হয়। এদের গবেষণার একটি অন্যতম খাত হলো কৃষি ও কৃষি যন্ত্রপাতির উন্নয়ন।

সংস্থাটির সাবেক পরিচালক কৃষি বিশেষজ্ঞ এ কে এম জাকারিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশে এত জায়গা থাকতে বগুড়ায় কেন কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরির এত সমারোহ আর এর গোড়াপত্তনই বা কীভাবে হলো।

তিনি বলেন, এর পেছনে কিছু মানুষ রয়েছে। তারা খুব উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন উদ্যোক্তা ছিলেন। তার মধ্যে দু-একজনের নাম তিনিও ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছেন। এদের মধ্যে আছেন টুলু ইঞ্জিনিয়ার, ধলু মেকানিক। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আমির হোসেন। এ লোকগুলো প্রথমে শুরু করেছিলেন। তাদের দেখাদেখি ধীরে ধীরে এর পরিসর বড় হয়েছে।

jagonews24

কে এম জাকারিয়া আরও বলেন, ‘ধলু মেকানিকের ছেলে আমির হোসেন। তিনি তার উদ্ভাবনী কারিশমার কারণে এ একাডেমি থেকে যন্ত্রবিজ্ঞানীর সার্টিফিকেট পেয়েছেন।’

আরও পড়ুন: স্থলবন্দরের প্রথম ই-গেট বেনাপোলে, ৪০ সেকেন্ডে যাত্রী পার

কথিত আছে, এ ধলু মেকানিকই ১৯৪০ সালের দিকে বগুড়ায় প্রথম হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা স্থাপন করেন। তার দেখাদেখি পরে ধীরে ধীরে হালকা প্রকৌশল শিল্পের কারখানা বিস্তার লাভ করে শহরজুড়ে।

বগুড়ার উদ্ভাবক আমির হোসেনের উদ্ভাবিত একটি যন্ত্রের একপাশ থেকে পাটগাছ ঢুকিয়ে দিলে আরেক পাশ দিয়ে আঁশ ও পাটকাঠি থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে। আরেকটি যন্ত্র নষ্ট হওয়া ভুট্টাগাছ থেকে তৈরি করে উন্নতমানের গোখাদ্য।

আমির হোসেন তার কারখানায় আরও তৈরি করেছেন হস্তচালিত ধানকাটা যন্ত্র, গুটি ইউরিয়া তৈরির যন্ত্র, অটোমেটিক মাছের খাদ্য তৈরির মেশিনসহ আরও হরেক যন্ত্র। তিনি বলেন, সব মেশিনই তিনি তৈরি করেছেন দেশীয় প্রযুক্তিতে। অত্যন্ত সুলভ মূল্যে এগুলো কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন।

আমির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, তাদের এ শিল্প আজ বিরাট আকার ধারণ করলেও অনেকটা অনানুষ্ঠানিকভাবেই চলছে। এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য কোনো নীতিমালা নেই। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও তারা খুব একটা পান না।

jagonews24

আরও পড়ুন: বেনাপোলে ছোলা আমদানি বাড়লেও বাজারে দাম চড়া

মীর ফরিদ একজন আদর্শ কৃষক। নিজে বিএ পাস। চার ছেলেমেয়ের সবাই প্রতিষ্ঠিত। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে ধান কাটার জন্য কামলা (শ্রমিক) খুঁজে পাওয়া যেতো না। তবে এখন দিন পাল্টেছে। এখন ধান কাটার জন্য আধুনিক কলের কাঁচি ব্যবহার করেন। অনেকটা ফড়িংয়ের মতো দেখতে ছোট্ট এ যন্ত্রটি ১০ জন শ্রমিকের কাজ একাই করে দেয়। মাথায় লম্বা ব্লেড লাগানো কলের কাঁচি চালাতে একজনই যথেষ্ট।’

শুধু তাই নয়, ধান মাড়াইয়ের কাজেও থ্রেশার যন্ত্র ব্যবহার করেন মীর ফরিদ। তবে তার থ্রেশার মেশিনটি আকারে বড় এবং আধুনিক। এটিতে একটি শক্তিশালী মোটর লাগানো রয়েছে। ধানসহ গাছ মেশিনে দেওয়ার পর ধান আলাদা হয়ে এক স্থানে পড়ে এবং খড়গুলো ভিন্ন স্থানে জড়ো হয়।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক) বগুড়া কার্যালয় সূত্র জানায়, বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির ৯৭৮টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার মধ্যে অন্তত ৪০টি ঢালাই কারখানা। শ্যালো মেশিনের পাম্প তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ৩০টি। পাওয়ার টিলারের চাকা ও ধান মাড়াই মেশিন তৈরি হচ্ছে ২০টিরও বেশি কারখানায়। অন্যান্য কারখানায় মেশিনের অপর যন্ত্রাংশ তৈরি হচ্ছে। জমি নিড়ানি, বীজ বপনের জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্র ড্রাম সিডারও তৈরি হচ্ছে বগুড়ায়।

বগুড়ায় বিসিকের উপমহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বগুড়ায় কৃষি যন্ত্রাংশ তৈরির কারিগররা অত্যন্ত দক্ষ। তারা নিজেরাই মূল মেশিনের যন্ত্রাংশ তৈরি ও যন্ত্রাংশের ফর্মা তৈরি করছেন।

এসআর/জিকেএস