ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

‘ওঠাও বাচ্চা’তে সর্বস্বান্ত বগুড়ার মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক | বগুড়া | প্রকাশিত: ০৪:৫৮ পিএম, ০১ মার্চ ২০২৩

মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ‘ওঠাও বাচ্চা’। একজন শিশু চোখ বেঁধে তুলছে লটারির টিকিট। ভাগ্যবান ব্যক্তি পেয়ে যাচ্ছেন মোটরসাইকেল, টিভি, ফ্রিজসহ লাখ লাখ টাকার সোনার গহনা। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমেলার আড়ালে প্রকাশ্যে এই লটারি জুয়া চলছে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলায়। প্রশাসন বলছে সেখানে লটারি জুয়া না চালাতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাদের। কিন্তু তারপরও বিগত ১৮ দিন ধরে চলছে এই সর্বনাশা তৎপরতা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস আফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) সৌজন্যে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এই মেলা চালাচ্ছে। বগুড়া মাঝিড়া ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশে বি-ব্লক মার্কেট মাঠে মেলার প্রধান আকর্ষণই এই লটারি। বাড়িতে বসে ক্যাবল নেটওয়ার্কে দেখা যাচ্ছে লটারির লাইভ ড্র অনুষ্ঠান। আর এ কারণে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার নেশায় হাজার হাজার টাকার লটারির টিকিট কিনে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ।

আরও পড়ুন- অবৈধ অটোরিকশায় দুর্ভোগে বগুড়াবাসী

এসব টিকিট বিক্রি হচ্ছে জেলার আনাচে কানাচে। বাকি নেই শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথাসহ পুলিশ সুপার ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকাও।

jagonews24

টিকিট বিক্রেতা আব্দুল হালিম নামের একজন জানান, তারা নির্দিষ্ট একটি কমিশন পান। আর যে সিএনজি কিংবা ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে ঘোরাফেরা করেন তার ভাড়া বাবদ পান এক হাজার টাকা। সবমিলিয়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি করেন তিনি। তার গাড়ির মতো আরও ৪২০টি গাড়ি প্রতিদিন এই মেলার টিকিট নিয়ে বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে আবার পাশের জেলা জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও সিরাজঞ্জের সীমান্ত গ্রামগুলোতেও টিকিট বিক্রি করেন।

বিক্রেতা হালিমের তথ্য অনুসারে প্রতিদিন ৪২০টি গাড়ি থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকার টিকিট বিক্রি করলেও মেলায় আয় হচ্ছে প্রতিদিন ৮৪ লাখ টাকা। সেই হিসাবে গত ১৮ দিনে এই অংক দাঁড়ায় ১৫ কোটি ১২ লাখ টাকা।

বিক্রেতা মামুন জানান, তার গাড়ি থেকে যারা টিকিট কিনছেন তাদের বেশিরভাগই রিকশাচালক ও দিনমজুর।

মোটরসাইকেল পাওয়ার আশায় রিকশাচালক আবদুস সালাম প্রতিদিন ৫টি করে টিকিট কেনেন লোভে পড়ে। কিন্তু এ পর্যন্ত একদিনও পুরস্কার পাননি।

স্কুলছাত্রদের ভিড়ও লটারি ঘিরে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রিফাত জানায়, তার ভাই মুশফিক টিফিনের টাকা দিয়ে প্রতিদিন ৩-৪টি টিকিট কিনলেও পুরস্কার পায়নি। এভাবেই সব শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে লটারির নামে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা।

আরও পড়ুন- যানজট নিরসনে রঙিন স্বপ্ন এখনো সাদাকালো

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠে হাতেগোনা কিছু লোক ঘোরাফেরা করছেন। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প মেলা বলা হলেও সেখানে দোকান রয়েছে পেশাদার মেলায় অংশগ্রহণকারীদের। রয়েছে সুট কোর্টের দোকান, মেয়েদের শাড়ি-থ্রিপিসের দোকান। এছাড়া শোপিস, চুড়ি-ফিতা, আচার, ফুচকাসহ মোট ১৮টি দোকান সেখানে অংশ নিয়েছে।

jagonews24

মেলার পশ্চিম পাশে বিশাল মঞ্চ করা হয়েছে। সেখানে প্রতিদিন রাত ১০টায় লটারি অনুষ্ঠান হয়। ক্যাবল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এই ড্র অনুষ্ঠানটি প্রত্যেকে তার নিজ বাড়িতে বসে দেখতে পারেন। আবার টিকিটের পেছনে লেখা মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে বিজয়ী ভাগ্যবানকে তার পুরস্কার পাওয়ার তথ্যটি সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়ে দেয় মেলা কর্তৃপক্ষ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন দোকানদার বলেন, ৫০ হাজার টাকায় দোকান নিয়েছি। বেচাবিক্রি নাই বললেই চলে। রাতে মেলায় ভিড় হয় ঠিকই, কিন্তু সেটা লটারি মঞ্চ ঘিরে। গেট লটারি বলা হলেও মূলত কোনো মানুষকেই তিনি টিকিট কেটে মেলায় ঢুকতে দেখেননি। যারা টিকিট কাটে তারা লটারি জুয়া খেলার জন্যই কাটে।

মঙ্গলবার দিনভর বগুড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, লটারি প্রচারণা ও টিকিট বিক্রির খোলামেলা দৃশ্য। মাইকে বলা হচ্ছে, ‘আপনি নিজের জন্য কেনা টিকিটে মোটরসাইকেল নিন, স্ত্রীর জন্য নিন সোনার গহনা আর বাচ্চার জন্য টেলিভিশন। শ্রমিক ভাইয়েরা মাত্র ২০ টাকায়ই পেতে পারেন একটি করে দেড় লাখের ব্যাটারিচালিত রিকশা। বলা তো যায় না, ভাগ্যে থাকলে ঠেকায় কে?’

আর এতেই প্রচারণা গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ, গৃহবধূ, স্কুলছাত্র ও ছোট শিশুরা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মেলা শুরু করার পর ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে লটারি অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুন- অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর হচ্ছে হিরো আলমের সেই গাড়ি, লাগছে না খরচ

সোমবার এই মেলায় পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় ১০টি মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ কয়েক লাখ টাকার সোনার গহনা। টিকিট বিক্রি বেশি হওয়ায় প্রতিদিন পুরস্কারের সংখ্যা ও দাম বাড়ানো হচ্ছে। শেষে একটি নতুন কারগাড়ি দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ টাকা।

jagonews24

এভাবে মেলার প্রবেশ মূল্যের নামে হাজার হাজার টিকিট বিক্রি হচ্ছে কিন্তু মেলায় লোক নেই। মেলা বন্ধ না হতে এবং এ ব্যাপারে মিডিয়ায় নিজউ না করতে প্রতিদিন ৫ লক্ষাধিক টাকার ‘সালামি’ বিভিন্ন জনের কাছে পৌঁছে যায় বলে নিশ্চিত করেছেন মেলা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা।

এই অবৈধ লটারির বিষয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় আলোচনাও হয়। তারপরও থামেনি এই অবৈধ লটারি। জেলা প্রশাসন থেকে লিখিত চিঠি দিয়ে মেলায় লটারির নামে জুয়া বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা আমলে নিচ্ছেন না মেলার লটারির আয়োজকরা। বরং আয়োজকরা প্রথমে লটারির টিকিট বিক্রি শহরে করেছিলেন। এখন ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের আনাচে কানাচে। সাধারণত নিম্ন আয়ের সাধারণ লোকজনই এই লটারির ফাঁদে পা দিয়ে কষ্টে উপার্জিত অর্থ ও সঞ্চয় হারাচ্ছেন।

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পমেলার আড়ালে প্রকাশ্যে এই লটারি জুয়া প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হয় রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস আফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের (রাওয়া) এইচআর প্রধান মোস্তফা জামান ডালিমের কাছে।

তিনি বলেন, আমাদের সংগঠনের সৌজন্যে বগুড়ায় একটি মেলা চলছে এটি সঠিক। কিন্তু সেখানে লটারি কিংবা তার অনুমতি প্রসঙ্গে আমি কিছু জানি না। বিষয়টি জেনারেল ম্যানেজার অপারেশন বলতে পারবেন।

জিএম অপারেশন লে. কর্নেল একেএম আনজামুল হকের (অব) সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে ফোন না ধরায় এ ব্যাপারে কথা বলা যায়নি।

মেলায় লটারি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বগুড়া জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ কবির আহম্মেদ মিঠু বলেন, যারা টিকিট কিনছে তারা মেলায় না এলেও টিকিটের বিনিময়ে পুরস্কার পাচ্ছেন বিধায় টিকিট কিনছেন। তবে ২-৩ দিনের মধ্যে আমরা লটারির কার্যক্রম বন্ধ করবো।

এ বিষয়ে শাজাহানপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদা খানম বলেন, মেলা কর্তৃপক্ষকে লটারি বন্ধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা লটারি বন্ধ করছেন না। বিষয়টি আমি জেলা প্রশাসককে জানিয়েছি। তিনি নির্দেশনা দিলে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবো।

জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা এই মেলা ও লটারির অনুমোদন দিইনি। এই লটারি অবৈধ। এরইমধ্যে আয়োজকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জানতে পেরেছি চিঠি দেওয়ার পরও তারা লটারি বন্ধ করেননি। আমরা কেবল নেটওয়ার্কে লটারির ড্র’র সরাসরি প্রচার বন্ধে চিঠি দিয়েছি। লটারির কার্যক্রম বন্ধ না করলে মোবাইল কোর্ট চালানো হবে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) শরাফত ইসলাম বলেন, লটারি বিক্রি কিংবা মেলার ব্যাপারে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। বিষয়টি জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চ বলতে পারবে।

তবে জেলা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোতাহার হোসেনও একই ধরনের মন্তব্য করেন।

এফএ/জিকেএস