অবৈধ ইটভাটা: জরিমানায় সীমাবদ্ধ অভিযান
মেহেরপুরের ১০৩টি ইটভাটার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে কৃষিজমি, লোকালয় ও বিদ্যালয়ের আশপাশে। ইট পোড়াতে ব্যবহার করা হচ্ছে কয়লার পরিবর্তে কাঠ। প্রতিবছর শীতের শুরুতে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর পৃথক অভিযান চালিয়ে মোটা অর্থ জরিমানা করে। এরপরও ভাটা বন্ধ হয় না। বরং জরিমানার পর আরও জোরেসোরে কাজ করে ভাটাগুলো।
অবৈধ এসব ইটভাটায় এলাকার তিন ফসলি কৃষিজমির মাটি দিয়ে ইট তৈরি করা হচ্ছে। জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে বিভিন্ন গাছের কাঠ। মাটি বহন করতে ট্রাক্টরের চলাচলে গ্রামীণ সড়কগুলো বেহাল হয়ে পড়েছে। ক্ষেতে ধুলার স্তর পড়ে নষ্ট হচ্ছে ফসল। কিন্তু কিছুই যেন দেখার কেউ নেই।
সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন ইটভাটা ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে। সদর উপজেলায় ৯টি ইটভাটা রয়েছে যার প্রতিটির অবস্থান কৃষিজমি ও লোকালয়ের আশপাশে। সদর উপজেলার মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের পাশেই আলমপুর গ্রামে কৃষিজমির ওপর চলছে ‘ইরানি ব্রিক্স’র কার্যক্রম।
আরও পড়ুন- মুকুলে ভরে গেছে আমবাগান, বাম্পার ফলনের আশা
ভাটার মালিক ইমাদুল ইসলাম বলেন, ‘বছরে প্রায় ৫ লাখ টাকা ভ্যাট নেয় জেলা কাস্টম অধিদপ্তর। অন্যদিকে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে আলাদা টাকা দিতে হয়। এভাবে প্রতিটি ভাটা চলছে।’
গত ১৭ জানুয়ারি মুজিবনগর উপজেলায় খুলনা ও কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তর ১০টি ইটভাটাকে মোট ১৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করে। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর গাংনী উপজেলার চারটি ইটভাটাকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে উপজেলা প্রশাসন। এভাবে প্রতিবছর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে জরিমানা করে আসছে। কিন্তু ফল হচ্ছে না কিছুই।
গাংনী উপজেলার থানাপাড়ার একটি ইটভাটা ‘আস্থা’। একদিকে কাদামাটি দিয়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইট, অন্যদিকে তা পোড়ানো হচ্ছে ভাটায়। যেখানে ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করার কথা কয়লা, সেখানে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ। ভাটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে অসংখ্য কাঠ। আরও নামছে ট্রাকের পর ট্রাক কাঠ। কোথাও কয়লার লেশমাত্র নেই।
আরও পড়ুন- মেহেরপুরে প্রথমবারের মতো চিয়া চাষ
কথা হয় ইটভাটা মালিক আলামিন হোসেন স্বপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, গত বছর এক ট্রাক কয়লার দাম ছিল ১২-১৩ হাজার টাকা। এবার সে কয়লার দাম ২৭-২৮ হাজার টাকা। তারপরও চাহিদামতো মিলছে না কয়লা। গত বছর আমরা কয়লা দিয়ে পুরো মৌসুম ইট পুড়িয়েছি। এক ট্রাক ইট বিক্রি করেছি ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায়। এবার ২৮ হাজার টাকায় কয়লা কিনে কত টাকায় ইট বিক্রি করব? তাই বাধ্য হচ্ছি কাঠ দিয়ে ইট পোড়াতে।
ইটভাটার ১০০ গজ এলাকার মধ্যে বসবাস করা কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ইটবোঝাই গাড়ি সারাদিন-রাত চলাচল করে। গাড়ি যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধুলা উড়ে ঘর-বাড়িতে পড়ছে। ভাতের সঙ্গে ধুলাও খেতে হচ্ছে। বাড়ির গাছের পাতায় ধুলা পড়ে জমে রয়েছে। অনেকসময় শ্বাসকষ্ট নিয়ে দিন কাটাতে হয়। কেউ প্রতিবাদও করতে পারে না।
মুজিবনগর উপজেলার দারিয়াপুর এলাকার এম এন বি ভাটার মালিক মিজানুর রহমান বলেন, দেশের বেশিরভাগ ইটভাটা লোকালয়, বিদ্যালয় ও কৃষিজমির মাঝখানে গড়ে উঠেছে। পরিত্যাক্ত বা পতিত জমি কি বাকি রয়েছে কোথাও? মানুষ ভাটা কোথায় করবে? এত জরিমানা দিয়ে কি আর ভাটা চালানো যায়?
ভাটামালিক ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলার ১০৩টি ইটভাটার মধ্যে ১০০টি ইটভাটার নেই কোনো লাইসেন্স, নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও। কিন্তু প্রতিটি ভাটায় দৈনিক গড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ মণ কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। এতে করে জেলায় দৈনিক ৪১ হাজার ২০০ মণ কাঠ পুড়ছে।
আরও পড়ুন- কুয়াশা-শীতে নষ্ট হচ্ছে বোরো ধানের বীজতলা, বিপাকে কৃষক
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩-এর ১৬ ধারায় বলা আছে, ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে কাঠ ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় শাস্তি হতে পারে। ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে ২০১৩ সালে।
মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কের দারিয়াপুর এলাকায় কৃষিজমির মাঝে গড়ে উঠেছে শাপলা ব্রিকস। চলতি মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর ওই ইটভাটার মালিককে তিন লাখ টাকা জরিমানা করে। কিন্তু শুক্রবার সকালে ওই ভাটায় গিয়ে দেখা গেলো খুব জোরেসোরে কাজ চলছে। কেউ মাটি কাটায় ব্যস্ত তো কেউ কাদামাটি দিয়ে ইট তৈরি করছেন। ভাটার ওপর সারি সারি কাঠ সাজানো। এক শ্রমিক একটি করে কাঠ ছুড়ে দিচ্ছেন ভাটার মধ্যে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুজিবনগর উপজেলার এক ভাটামালিক বলেন, সিংহভাগ ভাটামালিকই ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবিধারী নেতা, কেউবা দলের নিষ্ঠাবান কর্মী অথবা দলের আশীর্বাদপুষ্ট। শুধুমাত্র সাধারণ ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে জরিমানা করা হয়। যারা ক্ষমতাসীন দলের নেতা তাদের ভ্যাটও দিতে হয় না। কাস্টম কর্মকর্তারা সাহস করে ভ্যাট নিতেও পারেন না।
জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ইটভাটার যে আইন, সেটি অত্যন্ত কঠিন। সে আইন মানতে গেলে জেলায় একটি ইটভাটাও থাকবে না। আইনটি শিথিল করার দাবি জানান তিনি।
তিনি বলেন, ভাটা বন্ধ করার জন্য এরইমধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর আমাদের চিঠি দিয়েছে। কিন্তু এ ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে আমরা যাব কোথায়? তাছাড়া অনেক টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি ভাটায়। তাই জেল-জরিমানা যাই হোক, তা উপেক্ষা করে আমাদের ভাটা চালাতে হবে।
মেহেরপুর গাংনী ডিগ্রি কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এনামুল আজিম বলেন, অবৈধ ইটভাটায় শুধুমাত্র জরিমানা করে পরিবেশ রক্ষা করা যাবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বাৎসরিক টাকা আয়ের জন্য অবৈধ ভাটাকে পুষে রেখেছেন। তা না হলে প্রতিটি ভাটা পরিবেশবান্ধব ভাটাতে পরিণত হতো। কাঠের বদলে কয়লা ব্যবহার করতো। অনিয়ম না থাকলে টাকা আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। সেকারণে এখনও অবৈধ এসব ইটেভাটা বীরদর্পে কৃষিজমির বুকে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার উপপরিচালক আতাউর রহমান বলেন, অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন তারা। তবে এসব ভাটা বন্ধে জেলা প্রশাসনকে কঠোর ভূমিকা রাখতে হবে। সকল প্রকার আইন মেনে পরিবেশ বান্ধব ভাটা তৈরি করলে অবশ্যায় তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হবে।
এফএ/জিকেএস