সরকারি সাহায্য নেন না
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখে মরতে চান শতবর্ষী ভাষাসৈনিক
দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করেননি ভাষাসৈনিক কয়েস উদ্দিন সরকার (১০০)। শতবর্ষী এ ভাষাসৈনিক একসময় ভেবেছিলেন লড়াই সংগ্রামের পর দেশে একদিন সুদিন আসবে। মানুষ খাবার পাবে, বস্ত্র পাবে, অধিকার পাবে, শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু তার ভাবনা আজও সত্যে পরিণত হয়নি।
কয়েস উদ্দিন জাগো নিউজকে জানান, তিনি রাজনীতি করেছেন মানুষের জন্য। খুব কষ্টে দেশ স্বাধীন করেছেন। অথচ দেশে যে যেভাবে পারছে লুটপাট করে খাচ্ছে। তিনি কিছুই চান না, শুধু দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ দেখে মরতে চান।
কয়েস উদ্দিন সরকার জামালপুরে বেঁচে থাকা একমাত্র ভাষাসৈনিক। সবাই তাকে কয়েস ভাই বলেই চেনেন। তিনি পৌরসভার বেলটিয়া মাদ্রাসা রোডের ছইমুদ্দিনের ছেলে। তার বাবা ব্রিটিশ আমলেই মারা যান। তখন তিনি ছোট ছিলেন। বর্তমানে জামালপুর রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন গেইটপাড় এলাকায় একটি জীর্ণশীর্ণ টিনশেড (দোকান) ঘরে বসবাস করছেন।
আরও পড়ুন: মাতৃভাষা হারাতে বসেছে ওরা
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণশীর্ণ ওই ঘরে একটি ছোট্ট চৌকিতে একাই বসবাস করছেন তিনি। ওপরে একটি খাঁচার ফ্যান। বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে জিনিসপত্র। সামনে ছোট একটি টেবিলে প্লাস্টিকের কিছু পানির বোতল। প্রস্রাব-পায়খানার জন্য ঘরের মাঝেই একটি খোলা কমোড বসানো রয়েছে। ওপরে মরিচা ধরা টিনের চাল, বৃষ্টির দিনে পানি পড়ে। চারদিকে মশা ভন ভন করছে। শহরের প্রধান সড়ক হওয়ায় ২৪ ঘণ্টা যানবাহনের শব্দ। এ ঘরেই সারাদিন একা একা শুয়ে বসে দিন কাটে তার। কথা বললেও চোখ খুলে বলতে পারছেন না। মাঝেমধ্যেই ভুলে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, কয়েস উদ্দিন সরকার একজন লড়াকু সৈনিক। সারাজীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন। লড়াই সংগ্রামে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে রাজপথে মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। ভাষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় সবসময় রাস্তায় থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িক মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হয়ে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। নিজের পয়সা ব্যয় করে মাইক ভাড়া করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় গণসংগীত পরিবেশন করেছেন। শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়-অবিচার নিয়ে গান রচনা করে নিজেই তাতে সুরারোপ করেছেন। বয়সের ভারে তিনি আজ নুইয়ে পড়েছেন। এখন আর আগের মতো চলাচল করতে পারেন না, মনে রাখতে পারেন না কিছুই।
আরও পড়ুন: আক্ষেপ ঘোচেনি সালামের স্বজনদের
কয়েস উদ্দিন বলেন, তারা যখন লড়াই সংগ্রাম করেছেন তখন মাইক ছিল না, মোবাইল ছিল না, ছিল না ইন্টারনেট। তারা কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে মাইক বানিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। মানুষ এখন রাজনীতি করে নিজের জন্য। এখন আর মানুষের কল্যাণে কেউ রাজনীতি করে না। রাজনীতিতে এসে যে যেভাবে পারছে লুটপাট করে খাচ্ছে।
জীর্ণশীর্ণ টিনশেড ঘরে বসবাস করছেন কয়েস উদ্দিন-ছবি জাগো নিউজ
তিনি আরও বলেন, ইউরোপ আমেরিকাতে শ্রমিক আন্দোলন নাই। ওই দেশে মানুষকে সম্মান করা হয়। তাদের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়। এই দেশের মানুষ ওইসকল দেশে গেলে আর ফিরে আসতে চায় না। তাই সাগর পাড়ি দিয়ে ওই সকল দেশে যাওয়ার সময় মারা যাচ্ছে অনেকে।
প্রশ্ন ছিল এমন জীর্ণশীর্ণ ঘরে থাকতে কষ্ট হয় কি-না তার, জাগো নিউজ তিনি জানান, কষ্টের কথা মনে করলে থাকতে পারতেন না। যদি মনে করতেন টিনের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে, মশা কামড়ায়, তাহলে কীভাবে থাকতেন। সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়েও বেঁচে আছেন। তবুও কারো কাছে মাথা নোয়াতে চান না।
আরও পড়ুন: এখনো শহীদ মিনার পায়নি ৪৭১ বিদ্যালয়
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির জামালপুর জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাহারুল হক, ১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তিনি। মাঝেমধ্যেই কয়েস উদ্দিন সরকারের কাছে এসে সঙ্গ দেন, শোনেন তার না বলা কথা।
মোজাহারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, কয়েস ভাই অত্যন্ত ভালো মানুষ। ছোটকাল থেকেই তাকে মানুষের জন্য কাজ করতে দেখেছি। সকল আন্দোলনেই তার ছিল স্বরূপ উপস্থিতি। কিন্তু পৈত্রিক সম্পত্তি আত্মীয়-স্বজনের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে শেষ সময়ে এখন আর চলতে পারছেন না। তবুও তিনি কিছুই চান না। তিনি রাজনীতি করেছেন মানুষের কল্যাণে, তাই তার বিনিময়ে রাষ্ট্রের কাছে কিছুই চান না। দুর্নীতিমুক্ত একটি বাংলাদেশ দেখে মরতে চান তিনি।
আরও পড়ুন: সংখ্যালঘু-আদিবাসী ভাষাকেও গুরুত্ব দিতে হবে
এ বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। একজন ভাষাসৈনিক। শেষ জীবনে তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেন বিধিব্যবস্থা করা হয়।
জামালপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) শ্রাবস্তী রায় জাগো নিউজকে বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে কয়েকবার সাহায্য-সহযোগিতার চেষ্টা করা হলেও তিনি সরকারের কাছ থেকে কোনোকিছুই নিতে রাজি হননি।
তবে এবার তাকে পুরস্কৃত করা হবে বলেও জানান তিনি।
নাসিম উদ্দিন/এসএইচএস/জেআইএম