দেশের দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেও ধুঁকছে জয়পুরহাটের পোল্ট্রিশিল্প
![দেশের দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেও ধুঁকছে জয়পুরহাটের পোল্ট্রিশিল্প](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/355-20230203161112.jpg)
জয়পুরহাটে পোল্ট্রিশিল্পে লাভ-লোকসানের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এ শিল্পে জড়িত কয়েক লক্ষাধিক মানুষের রোজগারের পথও চলছে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে। ব্যবসায় লাভ লোকসান থাকলেও কয়েক বছর ধরে পোল্ট্রি খামারিদের লোকসানই যেন নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। তাই এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন খামারী ও ব্যবসায়ীরা।
জয়পুরহাট জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য সোনালি মুরগি। জেলায় এই পোল্ট্রি শিল্পের বিপ্লব ঘটে প্রায় দুই যুগ আগে। এই শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে রয়েছে জয়পুরহাট সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। জেলাজুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে সাড়ে ১০ হাজারের বেশি মুরগির খামার আছে। পোল্ট্রি শিল্পকে ঘিরে ফিড মিলও গড়ে উঠেছে। জেলার আড়াই লাখ মানুষ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত।
এ জেলায় পোল্ট্রিশিল্পে প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোটি টাকার লেনদেন হয়। এই শিল্পে সারাদেশের মধ্যে জয়পুরহাট দ্বিতীয় আর সোনালি মুরগি উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম। সোনালি জাতের এই মুরগির উদ্ভাবনও জয়পুরহাটেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রুকিন্দীপুর ইউনিয়নের জামালগঞ্জে অবস্থিত সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। ব্রিটিশ আমলে অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে ৩০ বিঘা জমিতে সরকারি এ খামারটি নির্মিত হয়। তবে বৃটিশ আমলে খামারটি নির্মিত হওয়ার পর খামারটি সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে ১২টি শেড, যার মধ্যে চারটি শেড পরিত্যক্ত। পদসংখ্যা ২১ জন হলেও কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬ জন। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জামালগঞ্জে অবস্থিত এই খামারের প্রথম নাম ছিল সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। এখন হাঁস বাদ দিয়ে নামকরণ হয়েছে সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামার। ২০০০ সালের পর মূলত জেলায় পোল্ট্রি শিল্পের বিপ্লব ঘটে। তৎকালীন সরকারি হাঁস-মুরগি খামারের সহকারী পরিচালক মো. শাহ জামাল সোনালি জাতের মুরগি উদ্ভাবন করেন। প্রথমে শাহাপুর গ্রামের ১০টি মুরগির খামারে নতুন জাতের এই সোনালি মুরগি পরীক্ষামূলকভাবে লালনপালন শুরু হয়। নতুন উদ্ভাবিত সোনালি জাতের এই মুরগি দেখতে অনেকটা দেশি মুরগির মতো, মাংসের স্বাদও একইরকম হওয়ায় খুব সহজে এই মুরগির মাংস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আরো পড়ুন- জয়পুরহাটে বেগুনি ফুলকপি চাষে সফল দম্পতি
২০১০ সালের দিকে দেশব্যাপী নতুন জাতের এই সোনালি মুরগির বিস্তৃতি লাভ করে। জয়পুরহাট জেলাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে একের পর এক বাণিজ্যিকভাবে সোনালি মুরগির খামার গড়ে ওঠে। আগে যে জমিতে ফসলের চাষ হতো এখন সেখানে গড়ে উঠেছে চার থেকে ছয় তলার মুরগির খামার।
জয়পুরহাটসহ এ জেলার নিকটবর্তী কয়েকটি অঞ্চলে ১১টি পোল্ট্রি ফিড কারখানা ও ৬৩টি হ্যাচারি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বৃহৎ পোল্ট্রি জোন। এখান থেকে প্রতিদিন তিন লাখ একদিনের সোনালি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন এবং খামারগুলো থেকে বছরে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন মুরগির মাংস ও প্রায় ৪০ কোটি ডিম উৎপাদন হত। যা দেশের মানুষের আমিষের চাহিদার ৫০ ভাগ যোগান দিত।
তবে জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ সরকারি হাঁস-মুরগি খামারকে কেন্দ্র করে এখানে পোল্ট্রিজোন গড়ে ওঠার পরও দীর্ঘ সময় ধরে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার পোল্ট্রি শিল্প। কাঁচামালের শতকরা ৮০ ভাগ আমদানিনির্ভর হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেশি, মুরগি ও ডিম রপ্তানি না হওয়া, চাহিদার সঙ্গে উৎপাদনের সমন্বয়হীনতা, সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকা, খাদ্য-ওষুধ-ভিটামিনের দফায় দফায় মূল্য বৃদ্ধি, এমনকি অনেক সময় নিম্নমানের খাদ্য-ওষুধ-ভিটামিন খাওয়ানোর ফলে রোগ/ব্যাধিমুক্ত না হয়ে বরং মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়া বা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সঠিক ওজন না হওয়া, মধ্যস্বত্তভোগী ফড়িয়া বা দালালদের দৌরাত্ম্য, পাইকারি ও খুচরা বাজার মূল্যের বিস্তর পার্থক্য, প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে যোগাযোগ বিঘ্নিত হলে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুরগি ও ডিম সরবরাহ বন্ধ হওয়া, মুরগির বাচ্চা-খাদ্য-ওষুধসহ বিভিন্ন উপকরণ বাকিতে বেচা-কেনা, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে দেশের মধ্যেই মুরগি ও ডিমের বাজার সীমিত হয়ে মুরগি ও ডিমের বাজার অধিকাংশ সময় অস্থিতিশীল থাকে। এছাড়াও করোনার কারণে ক্রমাগত লোকসানে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ লোকসানের পর বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার পোল্ট্রি খামার চলমান রয়েছে।
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার জামালগঞ্জের শেফালি পোল্ট্রি খামারের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি প্রথমে খুব ছোট পরিসরে মুরগির খামার শুরু করেন। এখন ৩০টি খামার। তারমধ্যে চারটি ছয়তলা, একটি তিনতলা, বাকি সবগুলো একতলা বিশিষ্ট মুরগির খামার। সম্ভাবনাময় এই শিল্পটিতে বর্তমানে প্রায়ই লোকসান গুনতে হচ্ছে। আবার প্রতিনিয়ত খাদ্যের দামও বাড়ছে। ওষুধের দাম চারগুণ বেড়েছে আবার শ্রমিকের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে।
আরো পড়ুন- জয়পুরহাটে পরচুলায় ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন সহস্রাধিক নারী
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ওমর পোল্ট্রি খামারের মালিক মনোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে তার তিনতলা বিশিষ্ট খামারে দশ হাজার মুরগি রয়েছে। এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় অনেকেই এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন, তবে এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
জয়পুরহটের আক্কেলপুর উপজেলার জগদীশপুর গ্রামের মোতালেব হোসেন ও মিন্নুর মিয়া বলেন, এক সময় এই পোল্ট্রি শিল্পে সুদিন থাকলেও ক্রমাগত লোকসানের কারণে খামার বন্ধ করে দিয়েছি।
বিজলী ফিডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বু হোসাইন বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বাজারে মুরগির দাম কম হওয়ায় অনেক খামারি লাভবান হতে পারছেন না। বিধায় অনেক উদ্যোক্তা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং আরও উদ্যোক্তা তৈরিতে সরকারের এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
পদ্মা ফিড অ্যান্ড চিকস্ লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ারুল হক আনু জানান, কাঁচামালের মূল্য নির্ধারণ হয় ডলারের মূল্যের ওপর ভিত্তি করে। ডলারের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় মুরগির খাদ্যের দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে জরুরি আমিষ সরবরাহকারী এই পোল্ট্রিশিল্পে উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনায় চরম গাফিলতি রয়েছে কর্তৃপক্ষের। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মুরগী ও ডিম উৎপাদন নীতি বাস্তবায়নের দাবিও জানান তিনি।
জয়পুরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ও পোল্ট্রি ব্যবসায়ী আহসান কবির এপ্লব বলেন, এ শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পোল্ট্রি শিল্প স্থবির না বরং ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটা হলে পোল্ট্রি শিল্পে কর্মরত এই জেলার লাখ লাখসহ সারা দেশের কয়েক লাখেরও বেশি মানুষ বেকার হবে। তাই পোল্ট্রি শিল্পের এ দুরাবস্থা থেকে রক্ষা করতে এখানে মুরগির মাংস প্রসেসিং প্লান্টসহ হিমাগার প্রয়োজন। করোনার কারণে ক্রমাগত লোকসানে একের পর এক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ লোকসানের পর বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার পোল্ট্রি খামার চলমান রয়েছে। করোনাকালীন সরকার খামারিদের স্বল্প সুদে সহজ শর্তে ঋণ দিলেও অনেকে খামারিই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। এছাড়া শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকিসহ রপ্তানির জন্য সরকারের পদক্ষেপ আশু প্রয়োজন।
আরো পড়ুন- ২০০ বছরের সন্ন্যাসতলী মেলায় হাজারো মানুষের ভিড়
জয়পুরহাট সরকারি মুরগি প্রজনন ও উন্নয়ন খামারের উপপরিচালক জুয়েল রানা বলেন, সরকারি পুরাতন ও বড় খামারের মধ্যে প্রথম সারির খামার এটি। এই খামারকে কেন্দ্র করে জেলায় হাজারো উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। জেলার আড়াই লাখ মানুষ এখন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে বর্তমানে খামারটির ১২টি শেডের সবগুলো জরাজীর্ণ। এরমধ্যে চারটি পরিত্যক্ত। খামারে বর্তমানে মুরগি রয়েছে সাত হাজার। খামারটি যদি দ্রুত গতিতে সংস্কার না করা হয় তাহলে খামারটির ঐতিহ্য ধরে রাখা কঠিন হবে।
জয়পুরহাট জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মাহফুজার রহমান বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর খামারিদের প্রশিক্ষণ, নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও কারিগরি সহায়তায় নিবিড় তদারকি করছে। এই শিল্পের অব্যাহত উন্নতি ধরে রাখার পাশাপাশি জনসাধারণের প্রাণিজ পুষ্টি নিশ্চিতকরণে কৃষি বিভাগের ন্যায় ভর্তুকি দেওয়া হলে দেশে আমিষের চাহিদা মিটিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে এবং এ শিল্পে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে বলে তিনি আশা করেন।
এফএ/জিকেএস