হারিয়ে যাচ্ছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গাপুড়া পিঠা
এক সময় বাঁশ কেটে চুঙ্গা বানিয়ে এর ভেতর ভেজা চাল ভরে এক ধরনের খাবার তৈরি করতেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন। ধীরে ধীরে এ খাবার সিলেট ও মৌলভীবাজারের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ওঠে। খাবারটি এখন চুঙ্গাপুড়া পিঠা নামে বহুল পরিচিত।
শীত এলেই বাজার থেকে মাছ কিনে কিংবা হাওর-নদী থেকে বড় বড় রুই, কাতল, চিতল, বোয়াল, পাবদা, কই, মাগুর মাছ ধরে এনে হালকা মসলা দিয়ে ভেজে (আঞ্চলিক ভাষায় মাছ বিরান) দিয়ে এ পিঠা খাওয়া ছিল অন্যতম ঐতিহ্য। বাড়িতে মেহমান বা নতুন জামাইকে শেষ পাতে চুঙ্গাপুড়া পিঠা, মাছ বিরান আর নারিকেলের পিঠা পরিবেশন না করলে যেন লজ্জায় মাথা কাটা যেত।
বর্তমানে সেই দিন আর নেই। চুঙ্গাপিঠা তৈরির প্রধান উপকরণ ঢলুবাঁশ ও বিন্নি ধানের চাল (বিরইন ধানের চাল) সরবরাহ এখন অনেক কমে গেছে। অনেক স্থানে এখন আর আগের মতো বিন্নি ধান চাষাবাদও হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজারের বড়লেখার পাথরিয়া পাহাড়, জুড়ীর লাঠিটিলা, চা-বাগানের টিলা ও রাজানগরসহ বিভিন্ন টিলায় এবং কুলাউড়ার গাজীপুরের পাহাড় ও জুড়ী উপজেলার চুঙ্গাবাড়িতে প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেতো। এর মধ্যে চুঙ্গাবাড়ি এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল ঢলুবাঁশের জন্য। বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে বাঁশ। জেলার কিছু কিছু টিলায় এখনো ঢলুবাঁশের দেখা মেলে। তবে সরবরাহ তুলনামূলক কম থাকায় দামও অনেক চড়া।
স্থানীয়রা জানান, ঢলুবাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরি করা যায় না। এ বাঁশে এক ধরনের তৈলাক্ত রাসায়নিক পদার্থ আছে, এর ফলে বাঁশ পুড়ে না। ভেতরে দেওয়া পিঠা আগুনের তাপে সিদ্ধ হয়। চুঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করা হয়। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে মোমবাতির মতো চুঙ্গা থেকে পিঠা আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গাপিঠা পোড়াতে আবার প্রচুর পরিমাণ খড় দরকার পড়ে। খড়ও এখন সময়ের প্রয়োজনে দাম একটু বেশি।
এখন বাঁশের সরবরাহ কমেছে। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌষ সংক্রান্তির সময় ঢলুবাঁশ কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ ও মুন্সীবাজারসহ বিভিন্ন হাটে দেখা যায়।
শনিবার (১৪ জানুয়ারি) কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা যায়, ঢলুবাঁশের পসরা সাজিয়ে বসেছেন অনেকে। ভিড় না থাকলেও কিছু সময় পর পর ক্রেতারা বাঁশ কিনছেন।
জেলার টেংরাবাজারে ঢলুবাঁশের চুঙ্গা নিতে আসা মাহি বখস বলেন, চুঙ্গার ভেতরে চালের গুঁড়া দিয়ে তা আগুনে পুড়িয়ে খেতে আলাদা মজা। তাই চুঙ্গা নিতে এসেছি। তবে দাম বেশি থাকায় অল্প নিয়েছি।
মুন্সীবাজারে ঢলুবাঁশ নিতে আসা পরিমল দেবনাথ, নিবাস চন্দ ও আব্দুল বাছিত খান বলেন, সব সময় তো এ জিনিসগুলো পাওয়া যায় না। পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে এগুলো খুব কম পরিমাণ বাজারে উঠেছে। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগে প্রচুর দেখা যেত। এখন কালের পরিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাজারে আসার সময় পরিবারের সদস্যরা বললো পিঠা তৈরির জন্য ঢলুবাঁশ নিতে হবে। তাই কিছু ঢলুবাঁশ কিনেছি।
রাজনগরের চা শ্রমিক নেতা সত্যনাইডু জাগো নিউজকে বলেন, কমলগঞ্জ উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর ঢলুবাঁশ পাওয়া যেত। এর মধ্যে চুঙ্গাবাড়িও এক সময় প্রসিদ্ধ ছিল ঢলুবাঁশের জন্যে। অনেক আগেই বনদস্যু ও ভূমিদস্যু এবং পাহাড়খেকোদের কারণে বনাঞ্চল উজাড় হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছে ঢলুবাঁশ। তবে জেলার কোনো কোনো পাহাড়ি এলাকায় এ বাঁশের দেখা মেলে।
কমলগঞ্জ উপজেলার লেখক-গবেষক আহমদ সিরাজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে কমবেশি সবার বাড়িতে ঢলুবাঁশ ছিল। এখন সেই বাঁশ আগের মতো নেই। এই বাঁশ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। একসময় এ বাঁশ দিয়ে চুঙ্গাপুড়ার ধুম লেগেই থাকতো।
এসজে/এমএস