জৌলুস হারাচ্ছে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক
অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় জৌলুস হারাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। গত ১০ বছরেও পার্কটি দেখার পুরোপুরি সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে দর্শনার্থীদের মাঝে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানান, ২০১৩ সালে পার্কটি উদ্বোধন করা হয়। এরপর দেশি-বিদেশি বন্যপ্রাণীর বংশবৃদ্ধি ও অবাধ বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে যাতে পর্যটকরা চলমান যানবাহনে অথবা পায়ে হেঁটে শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ লাভ করবেন। আর সাফারি পার্কের ধারণা চিড়িয়াখানা হতে ভিন্নতর। পার্ক নিয়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা আর বিনোদনের কথা বলা হলেও বর্তমানে এসব বিনোদন থেকে বঞ্চিত সাধারণ দর্শনার্থীরা। বিশেষ করে একের পর এক প্রাণীর মৃত্যু ও অব্যবস্থাপনার কারণে ক্রমেই জৌলুস হারাচ্ছে পার্কটি।
গত বছরের ২ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাফারি পার্কে ১১টি জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহ মারা যায়। এসব প্রাণী মারা গেলেও সে সময় সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়নি। এমনকি বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য যাচাই করতে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীরা বারবার যোগাযোগ করলেও তিনি এগুলো পুরোপুরি অস্বীকার করেন। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইকবাল হোসেন প্রাণীর মৃত্যুর তথ্য যাচাইয়ের জন্য সাফারি পার্কে সশরীরে উপস্থিত হন। এতগুলো প্রাণীর মৃত্যুর তথ্যগুলো গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেন তারা। এরপর প্রাণী মৃত্যুর কারণ জানতে বন বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তর পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব তদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অবহেলা পাওয়া যায়। ওই ঘটনায় তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান, বন্যপ্রাণী পরিদর্শক সরোয়ার হোসেন, বন্যপ্রাণী চিকিৎসক জুলকারনাইন মানিক ও পার্কের প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবিরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে সম্প্রতি গাজীপুরের শ্রীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে একটি হাতির মৃত্যুর তথ্য খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেছে সিংহী ও ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর তথ্য। সংশ্লিষ্ট থানার সাধারণ ডায়েরি ও বন বিভাগের একাধিক সূত্রে এসব জানা গেছে। তবে পার্ক কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমের কাছে এসব বিষয় সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন।
সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি ওয়াইল্ডবিস্ট ও একই বছরের ডিসেম্বর মাসে একটি সিংহীর মৃত্যু হয়েছে। এসব তথ্য এতোদিন গোপন রাখে সাফারি পার্ক অফিসের কর্মকর্তারা। গত ২১ ডিসেম্বর একটি হাতির মৃত্যুর তথ্যও প্রথমে প্রকাশ করা হয়নি। পরে থানায় দায়ের সাধারণ ডায়েরি থেকে ঘটনার ১১দিন পর বিষয়টি জানা গেছে।
এ ব্যাপারে সাফারি পার্কের প্রকল্প পরিচালক ইমরান আহমেদ বলেন, সিংহীটি বার্ধক্যে পরিণত হয়েছিল। এটি ছিল শারীরিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল। প্রাণীটির মৃত্যুর পর এর ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। তদন্তে প্রাণীটি হার্ট এটাকে মারা গেছে বলে জানতে পেরেছি। এর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নমুনা দেশের বেশ কয়েকটি পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এসব পরীক্ষা থেকে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছোঁয়াচে রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়নি।
গাজীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার (কালিয়াকৈর সার্কেল) মো. আজমীর হোসেন বলেন, গত ২০ নভেম্বর শ্রীপুর থানায় সাফারি পার্কে ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। সেখানে ১৯ নভেম্বর একটি ওয়াইল্ডবিস্টের মৃত্যুর বিষয়টি উল্লেখ আছে। সাধারণ ডায়েরি করেছেন পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম।
এ ব্যাপারে পার্কের প্রকল্প পরিচালক ইমরান আহমেদ বলেন, প্রাণী জন্ম-মৃত্যু এগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রাণী মারা গেলে আমাদের চিকিৎসক আছেন তারা পোস্টমর্টেম করবেন। এগুলো স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক কিছু হলে আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি রিপোর্টিং করা হয়। এমনকি স্থানীয় পর্যায়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পার্কের একটি সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ১৬ তারিখে সিংহীটির মৃত্যু হয়। এর আগে জেব্রা, সিংহ ও বাঘের মৃত্যু নিয়ে পার্ক কর্তৃপক্ষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। ফলে এবার সিংহ মারা যাওয়ার পর এ তথ্য পার্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে সেটির ব্যবস্থাপনা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পার্কের এক কর্মচারী জানান, অনেক সময় পার্কের প্রাণীদের সঠিক খাবার সরবরাহ করা হয় না। প্রাণীদের নেওয়া হয়না যথাযথ যত্ন। বোবা প্রাণীরা যদি কথা বলতে থাকতো তাবে সবাই জানতো তাদের কী ধরনেরর যত্ম নেওয়া হয়। কোন ধরনের খাবার দেওয়া হয়। পার্কে চাকরির কারণে কোনো কথা বলতে পারি না। তবে প্রাণীদের দেখলে মায়া হয়।
সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেব্রার পাল ছিল ৩১ সদস্যের। গত বছরের শুরুর দিকে ১১টির মৃত্যুর পর পার্কে এখন আছে ২০টি জেব্রা। এছাড়া একটি বাঘের মৃত্যুর পর এখন তাদের পরিবার ৯ সদস্যের। সর্বশেষ গত মাসে একটি সিংহী মারা যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে বর্তমানে সিংহী আছে মাত্র একটি। সিংহ আছে সাতটি।
সাফারি পার্ক দেখতে আসা দর্শনার্থী মো. এমদাদুল হক বলেন, পার্কটি দেখে মনে হচ্ছে পার্কের প্রাণীদের প্রতি তেমন যত্ম নেওয়া হয় না। ধীরে ধীরে পার্কটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পার্কে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আরও জোরদার করা দরকার।
ঢাকা থেকে পার্কে বেড়াতে আসা দর্শনার্থী শিমলা আক্তার জানান, টিকেট কেটে পার্কে গেলেও সেখানে কোনো প্রাণী চোখে পড়ে না। বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। ভিতরে অনেক ঝোঁপঝাড় থাকায় প্রাণীরা সেখানে লুকিয়ে থাকে তাই সচরাচর তাদের দেখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম পার্কের কোন বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং পাখি ও বন্যপ্রাণী চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ আ ন ম আমিনুর রহমান বলেন, সাফারি পার্ক কর্তৃপক্ষের কোথাও হয়তো কোনো দুর্বলতা আছে। যার কারণে তারা পশুপাখির মৃত্যুর খবর গোপন রাখে। তবে এটি গোপন না রেখে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে সমস্যার সমাধান করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রাণী রয়েছে। এদের এককটির বৈশিষ্ট্য একেক রকম। তাই নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণীর জন্য ওই বিষয়ে পারদর্শী চিকিৎসক দরকার। প্রাণীগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ক্যাটাগরি অনুযায়ী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া দরকার।
মো. আমিনুল ইসলাম/আরএইচ/জিকেএস