শীতের পিঠা বিক্রি করে দৈনিক আয় ২০০০-৩৫০০ টাকা
মাদারীপুর শহরের বিভিন্ন গলিতে, রাস্তার মোড়ে এবং লোকালয়পূর্ণ স্থানগুলোতে শীতের পিঠা বিক্রি করে বাড়তি আয় করছে শতাধিক পরিবার। বিশেষ করে পরিবারের নারী সদস্যরা বেশি এই পিঠা বিক্রি করছেন। কেউ একসঙ্গে চার থেকে ১০টি চুলা বসিয়েও পিঠা বানাচ্ছেন।
এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানে ক্রেতাদের ভিড়ও চোখে পড়ার মতো। কোনো কোনো দোকানে লাইনে দাঁড়িয়েও পিঠা কিনতে দেখা যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাদারীপুুর শহরের ডিসি ব্রিজ, শকুনি লেকপাড়, হাসপাতালের মোড়, থানার মোড়, ইটেরপুল, পুরানবাজারের রেন্ডিতলা, করাচি রোড, চৌরাস্তা, পানিছত্র, কাজির মোড়, পুরাতন ফেরিঘাট, পাকা মসজিদ রোড, জেলখানার কোনা, সৈয়দারবালী, শকুনি এলাকা, পাকদী, খাগদীসহ শহরের বিভিন্ন গলিতে, রাস্তার মোড়ে, লোকালয়পূর্ণ জায়গায় শতাধিক ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়ে পিঠা তৈরি করা হচ্ছে। মাটি দিয়ে চুলা তৈরি করে যে যার সুবিধামতো জায়গায় বসিয়ে পিঠা বানিয়ে বিক্রি করছেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কমপক্ষে চারটি চুলা থেকে শুরু করে ১০টি চুলা পর্যন্ত একসঙ্গে জ্বালিয়ে পিঠা বানাচ্ছেন তারা। অনেকে ভ্যানে চুলা বানিয়ে ঘুরে ঘুরেও পিঠা তৈরি করে বিক্রি করছেন।
নানা ধরনের পিঠার পাশাপাশি সবেচেয়ে বেশি দেখা যায় ভাপা পিঠা ও চিতই পিঠা বানাতে ও বিক্রি করতে। নারিকেল, আতব চালের গুঁড়া ও মাদারীপুরের ঐতিহ্যবাহী খেজুরের গুড় দিয়ে বানাচ্ছেন ভাপা পিঠা। চালের গুঁড়া দিয়ে চিতই পিঠা বানিয়ে তার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে শুঁটকি, ধনেপাতা, সরিষা, বাদাম, কালোজিরা, মরিচসহ নানা ধরনের ভর্তা।
মাদারীপুর শহরের মানুষের কাছে এই খাবার খুবই জনপ্রিয়। কাজ ও ব্যস্ততার জন্য আগের মতো ঘরে ঘরে পিঠা তৈরি করতে দেখা না গেলেও রাস্তার পাশে বসে এই পিঠা তৈরি এখন মাদারীপুরবাসীর ঐতিহ্য।
মাদারীপুরের এই ঐতিহ্যবাহী পিঠা অনেককেই রাস্তার পাশে বসেই গরম গরম খাচ্ছেন। আবার অনেকেই পিঠা কিনে পরিবারের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। ভ্রাম্যমাণ এই দোকানগুলো বিকেলে বসে। চলে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীত মৌসুমে এক শ্রেণির মানুষ অল্প পুঁজি ও কম পরিশ্রমে বেশি লাভ হওয়ায় পিঠা বানিয়ে তা বিক্রি করছেন। বিকেল হলেই শহরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক মাটির চুলা জ্বালিয়ে তার ওপর ছোট ছোট মাটি বা লোহার কড়াই বা হাঁড়ি বসিয়ে তাতে বানাচ্ছেন পিঠা। একটু পর পর ঢাকনা তুলে কড়াইয়ের মধ্যে চালের গুঁড়া, পানি ও লবণ দিয়ে গোলানো অংশ দিয়ে বানানো হচ্ছে চিতই পিঠা।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়ে যায় পিঠা। এই গরম গরম চিতই পিঠা নামিয়ে প্লেটে নানা ধরনের ভর্তা সাজিয়ে ক্রেতাদের দেওয়া হচ্ছে। প্রতি পিস চিতই পিঠা বিক্রি হয় ৫-১০ টাকা করে। আর ভাপা পিঠা বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকা করে। এতে একেকজন পিঠাবিক্রেতার দিনে আয় হচ্ছে দুই হাজার টাকা থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত।
মাদারীপুর শহরের গৃহবধূ সুবর্ণা বেগম বলেন, ‘বর্তমানে যে শীত পড়েছে তাতে ঘরে বসে বসে পিঠা খাওয়ার সময়। কিন্তু কাজের ব্যস্ততায় পিঠা বানাতে পারি না। তাই বাধ্য হয়ে স্বামী আর সন্তানদের জন্য রাস্তার পাশ থেকেই চিতই পিঠা কিনে এনেছি। সঙ্গে সরিষা, শুঁটকি ও ধনিয়া পাতার ভর্তা দিয়েছে। সবাই অনেক মজা করে খেয়েছে। আমার বিকেলের নাস্তাটাও হয়ে গেল।’
শহরের পুরানবাজার রেন্ডিতলা এলাকায় পিঠা বিক্রি করেন রোজী বেগম। তাকে সহযোগিতা করেন তার স্বামী মো. সাইফুল। পাশেই শান্তিনগর তাদের বাড়ি। দুই ছেলেমেয়ে। তাদের পড়াশোনা ও নিজেদের সংসারের সব খরচ জোগাড় হয় এই পিঠা বিক্রির টাকায়। বিকেল হলেই ভূমি অফিসের সামনে রাস্তায় চারটি আলগা মাটির চুলা নিয়েই বসে পড়েন পিঠা বানাতে। ভাপা ও চিতই পিঠা বানান। চিতই পিঠার সঙ্গে দেওয়া হয় শুঁটকি, মরিচ, বাদাম, কালোজিরা ও ধনিয়া পাতা ভর্তা। প্রতিদিন তাদের আয় হয় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা।
পিঠা বিক্রেতা রোজী বেগম বলেন, শীত এলেই পিঠা বানিয়ে বিক্রি করি। আমি একা সামাল দিতে পারি না। তাই আমার স্বামীও আমাকে সহযোগিতা করেন। লাভও হয় অনেক। এই শীতের সময় পিঠা বানিয়ে আয় করে তা দিয়ে সংসার চালাই।
পাশেই আরেক পিঠা বিক্রেতা মুক্তা বেগম। তাকেও স্বামী ফারুক সহযোগিত করেন। পাঁচটি চুলা বসিয়ে পিঠা বানান।
পিঠা বিক্রেতা মুক্তা বেগম বলেন, গত তিন বছর ধরে শীত এলেই পিঠা বানাই। প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টাকার মতো পিঠা বিক্রি হয়।
তার স্বামী ফারুক বলেন, মুক্তা একা একা পিঠা বানিয়ে তা সাজিয়ে বিক্রি করতে পারেন না। তাই আমি সকালে রিকশা চালাই আর বিকেলে তাকে সহযোগিতা করি।
পিঠা কিনতে আসা চাকরিজীবী রুনা বেগম বলেন, সারাদিন স্কুলে চাকরি করি। বাসায় এসে আর কিছু করতে ইচ্ছে করে না। পরিবারের সদস্যরা পিঠা খেতে চায়। তাই বাজার থেকে খেজুরের গুড় কিনে তা দিয়ে প্রথমে সিরা তৈরি করি। তারপর রাস্তার পাশ থেকে পিঠা কিনে এনে গরম গরম সেই সিরার মধ্যে ভিজিয়ে রাখি। সারারাত ভেজার পর সকালে নরম হয়ে যায় পিঠাগুলো। তখন সবাইকে খেতে দেয়। পরিবারের লোকজন মজাদার পিঠা খেয়ে অনেক খুশি হয়।
মাদারীপুর মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাহমুদা আক্তার কণা বলেন, শীত মৌসুম এলেই নিম্নআয়ের পরিবারের অনেক নারীরা রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ চুলা বসিয়ে পিঠা বানিয়ে তা বিক্রি করে আয় করছেন। এটা খুব ভালো উদ্যোগ।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও নারীদের এভাবে রাস্তার পাশে বসে পিঠা বানাতে দেখা যায়নি। তবে এবছর এ সংখ্যা অনেক বেড়েছে। পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি পিঠা বানিয়ে বিক্রি করছেন।
এসআর/জিকেএস