ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

বিলুপ্তপ্রায় স্লেট-পেন্সিল

শিশুদের এখন হাতেখড়ি হয় ডিজিটাল ডিভাইসে

আমিন ইসলাম জুয়েল | পাবনা | প্রকাশিত: ০৮:০৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২২

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো বদলে গেছে। বদলে গেছে শিখন-শেখানো পদ্ধতি। বদলে গেছে শিক্ষাউপকরণও। এসবের সঙ্গে বিদায় নিয়েছে পাথরের স্লেট আর বিশেষ ধরনের পেন্সিল। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে প্লাস্টিকের কিছু স্লেট দেখা যায়। যেগুলো সরকারিভাবে কয়েক বছর আগে দেওয়া হয়েছিল। তবে কারিকুলাম বদলে যাওয়ায় এখন আর সেগুলো ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এখন শিশুদের হাতেখড়ি হয় ডিজিটাল ডিভাইসে। ১৯৯০-৯১ সালের পর থেকে পাথরে তৈরি স্লেট-পেন্সিল হারিয়ে যেতে থাকে বলে বই ব্যবসায়ী এবং শিক্ষক-অভিভাবকরা জানিয়েছেন।

jagonews24

পাবনার প্রবীণজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ থেকে পাঁচ দশক আগে তারা পাথরের স্লেট-পেন্সিল দিয়ে হাতের লেখা শিখেছেন। স্লেটে লেখার পেন্সিলটাও থাকতো কার্বন দিয়ে তৈরি পাথুরে টাইপের। কয়লা দিয়ে স্লেট ধুয়ে ঝকঝকে করার কাজটিও তারা নিজ হাতে করতেন। বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে দোয়াতে বানানো ময়ূর কালিতে তালপাতায় লেখার অভিজ্ঞতাও তাদের রয়েছে। এখন প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে লেখার উপকরণ বদলে গেছে। এখন কালির কলম বিদায় নিয়ে এসেছে বল পয়েন্ট পেন। এখন আধুনিক যন্ত্রে তৈরি কাগজ আর রঙিন বই উঠেছে শিশুদের হাতে।

jagonews24

বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও শিক্ষক জানান, গ্রামের ভাঙা দোচালা স্কুলঘরে বর্ণ পরিচয় হয়েছে তাদের। ঘর আর বেঞ্চের অভাবে খোলা আকাশের নিচে সবুজ দুর্বা ঘাসে দলবেঁধে বসে সুর করে ধারাপাতের নামতা পড়েছেন তারা। স্কুল ছুটিতে হৈ হৈ করে বাড়ি ফেরার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের। কখনো হাঁটু সমান পানি ভেঙে কাদা মাড়িয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এখন প্রতিটি গ্রামে প্রাইমারি স্কুল আর দু-তিন গ্রাম পরই হাইস্কুল। এখন স্কুলগুলো সুসজ্জিত, দ্বিতল, তিনতলা ভবন। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণির আগে প্লে, নার্সারি, কেজি ইত্যাদি নামের ক্লাস যোগ হয়েছে। তবে এখন স্কুলঘর রঙিন হলেও শিশুরা তাদের সাত রঙা শৈশব হারিয়েছে। ক্লাস শুরুর আগে-পরে তিন-চারটা প্রাইভেট পড়া কিংবা পড়ন্তবেলায় বস্তাসম স্কুলব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের।

jagonews24

বেশ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি তাদের শৈশবকালে স্লেটের চক বানানোর কৌশল জানালেন। সেসময় তারা গোসল করতে গিয়ে পুকুরের পাড় থেকে নরম এঁটেল মাটি দলা বানিয়ে তুলে আনতেন। তারপর সেটা প্রথমে ছেনে হাতের তালুতে নিয়ে মাটির ওপর ঘষে লম্বা আকৃতি দেওয়া হতো। এরপর রোদে শুকিয়ে সেগুলোকে মাটির চুলায় রান্না শেষে যে আগুন থাকে, সেই আগুনে ফেলে ঢেকে দেওয়া হতো। এরপর একসময় সেই আগুনের ছাইগুলো ফেলার সময় বেছে বেছে চকগুলো আলাদা করে নেওয়া হতো। হাতে বানানো এই চক সাধারণ চকের মতো অতটা মোটা হতো না। এগুলোর বর্ণও সাধারণ চকের মতো সাদা হতো না; বরং মাটির রং অনুযায়ী একেকটা একেক রঙের হতো। সেগুলো দিয়ে স্লেটে লেখা হতো। আর লেখা মুছে ফেলার জন পুরোনো কাপড়ের একটা ছোট পুঁটলি ব্যবহার করা হতো। সেটা পানিতে ভিজিয়ে মোছার কাজে ব্যবহার করা হতো। ওদিকে, স্লেটে লেখার কাজটা চলতো। চক তৈরি আর মোছার পুটলি বানানোর কাজে শিশুদের মায়েরা সাহায্য করতেন।

jagonews24

পাবনার বেশকিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্লেটের ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। ৫-৬ বছর আগে বিদ্যালয়গুলোতে প্লাস্টিকের স্লেট আকৃতির বোর্ড সরবরাহ করা হয়েছিল। অনেক স্কুলে সেগুলো সংরক্ষিত রয়েছে। সেগুলো এখন ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এখন বর্ণ শেখানোর আধুনিক উপকরণ ডিজিটাল ডিভাইস থেকে শুরু করে প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। এছাড়া নতুন ক্যারিকুলামে শিশুদের জন্য বিশেষ ধরনের বই এবং খাতা সরবরাহ করা হয়েছে। সেখানেই শিশুরা লেখে।

jagonews24

বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র নাফিস, পঞ্চম শ্রেণির রাজকন্যা সরকার দিবা, পঞ্চম শ্রেণির অরিন্দম বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল নাগ জানিয়েছে, তারা শিশু শ্রেণিতে স্লেট ব্যবহার করেছে। তবে তা পাথরের নয়, প্লাস্টিকের। আর স্লেটে যে বিশেষ ধরনের পাথুরে পেন্সিল ব্যবহার করা হতো সেটা তারা চেনে না, তারা ব্যবহার করেছে চক। প্রাইমারি হাই স্কুলপড়ুয়া অনেক ছাত্রছাত্রী বলেছে, তারা স্লেট চেনে না। প্রাক- প্রাথমিক শ্রেণির পল্লব বিশ্বাস, রিতা ঘোষ জানিয়েছে, তারা এখন খাতায় পেন্সিল দিয়ে লেখে।

jagonews24

বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক-প্রাথমিক (শিশু) শ্রেণির শিক্ষক কানিজ ফাতেমা জানান, তার শ্রেণিতে সরকারিভাবে সরবরাহ করা প্লাস্টিকের স্লেট রয়েছে। তবে এখন এগুলো ব্যবহারের খুব একটা প্রয়োজন নেই। কারণ এ শ্রেণির শিশুদের লেখার জন্য সরকারিভাবে খাতা দেওয়া হয়েছে। তাদের বইতেও লেখার অপশন রয়েছে।

বহলবাড়িয়া গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আফসার আলী জানান, তারা শৈশবে স্লেট-পেন্সিল ব্যবহার করেছেন। তার সন্তানরা আর স্লেট-পেন্সিল ব্যবহার করেনি। তারা কাগজ-কলম ব্যবহার করেছেন। এখন বাজারে স্লেট পাওয়া যায় না। স্লেটে লেখার জন্য বিশেষ ধরনের কার্বন দিয়ে তৈরি সে পেন্সিলও পাওয়া যায় না। স্লেট-পেন্সিল এখন বিলুপ্ত প্রায়। তাদের শৈশবকালে পাথর কিংবা টিনের স্লেটে শেখা ভাষা এখন আধুনিক যুগে মোবাইলফোন ও কম্পিউটারে লেখা যায়।

jagonews24

পাবনার আতাইকুলার বই ব্যবসায়ী তপন কুমার সরকার জানান, বই-খাতা-কলম বিক্রি করা তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তার মনে আছে ১৯৯০-৯১ সাল পর্যন্ত চক-পেন্সিলের ব্যবহার হয়েছে। তিনি সেগুলো সর্বোচ্চ চার-পাঁচ টাকায় বিক্রি করেছেন। এরপর থেকে ঝরনা কলম (নিবওয়ালা) ও খাতার ব্যবহার বাড়তে থাকে। এখন তো শিশুদের অক্ষর শেখাতে ম্যাজিক বোর্ডসহ নানা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। তারাও এখন ব্যবসার ধরন পাল্টে আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন।

মিয়াপুর হাজী জছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক শাহজাহান আলী জানান, আগে শিশুদের হাতেখড়ি হতো স্লেট-পেন্সিল দিয়ে। এখন ডিজিটাল ডিভাইস দিয়ে হাতে খড়ি দেওয়া হয়। তারা ছোটবেলায় মূলত স্লেট-পেন্সিল দিয়েই লিখতেন। স্লেটে চকের ব্যবহারও ছিল না। খাতা কলমের ব্যবহারও খুব একটা ছিল না। তখন পেন্সিল ব্যবহার করা হতো। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। হারিয়ে গেছে স্লেট-পেন্সিল।

jagonews24

মিয়াপুর হাজী জছিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবু সাইয়িদ জানান, তিনি তার শৈশবে স্লেট-পেন্সিল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তার সন্তানরা আর স্লেট ব্যবহার করেনি। এমনকি স্লেট চেনেও না। এখন আধুনিক যুগে এসে তারা আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করছে। চক-পেন্সিল ধীরে ধীরে জাদুঘরেই চলে যাচ্ছে ।

এমআরআর/এমএস