উৎপাদন কমেছে ৫০ শতাংশ
বগুড়ায় তৈরি কাগজ শিল্পে বিপর্যয়
বগুড়ার শিল্পোদ্যোক্তারা ফেলনা পুরোনো কাগজ দিয়ে তৈরি করেন নিউজপ্রিন্ট, মিডিয়াম ও বোর্ড পেপার। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় পুরোটাই যখন শহরমুখী, তখন বগুড়ার গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল একের পর এক কাগজ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। টোকাই ও ফেরিওয়ালাদের হাত ঘুরে পুরোনো ও ফেলনা কাগজ দিয়ে বগুড়ায় তৈরি হতো নিউজপ্রিন্ট, মোড়কীকরণ শিল্পে ব্যবহারযোগ্য মিডিয়াম ও বোর্ড পেপার। এসব পণ্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে সমাদৃত। তবে অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি ও কাঁচামাল স্বল্পতায় এই শিল্পটি এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। উৎপাদন কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে ছয়টি পেপার ও ১৮টি বোর্ড পেপার মিল। এসব কারখানা বছরে দেড় লাখ টন কাগজ উৎপাদন করে, যা দেশীয় ছাপাখানা শিল্পে বিদেশি কাগজের নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি সরাসরি ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগে এসব কারখানায় কম পুঁজি লাগতো। কাঁচামালও ছিল সহজলভ্য। কিন্তু খরচের পাশাপাশি কাঁচামালের স্বল্পতাও প্রকট হয়েছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
বগুড়ায় তৈরি বোর্ড কাগজ ব্যবহার হয় উত্তরের প্রায় সব জেলায়ই। অল্প খরচের এই কাগজ বা বোর্ড তাদের তৈরি পণ্যের মোড়ক হিসেবে ববহার করে সাশ্রয়ী হাওয়ার চেষ্টা করেন। আগে কাগজ টোকানোর জন্য অভাবি ও ছিন্নমূল এবং ফেরি করে কাগজ ক্রয় করে এমন সহস্রাধিক পুরোনো কাগজ ব্যবসায়ী ছিল। এখন এদের অনেকেই এই কাজ করে না।
শহরের নুরানী মোড় এলাকার কাগজ ব্যবসায়ী নুরে আলম জানান, পুরোনো পত্রিকার দাম কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বাসাবাড়ি থেকে আগের মতো পত্রিকা পাওয়া যায় না। একইভাবে টুকিয়ে যারা কাগজ সংগ্রহ করতো তাদের অনেকেই পেশা বদলেছেন।
বগুড়া শহরের নিশিন্দারা কারবালা, মাটিডালি, কাহালু উপজেলা সড়কের আড়োলা, বগুড়া সদরের জয়বাংলা মোড়, শহরের জয়পুরপাড়া, এরুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পুরোনো বা টোকানো কাগজ দিয়ে নতুন করে কাগজ তৈরির ১৮টি মেশিন বসানো হয়েছে। এই মেশিন দিয়ে বিগত ছয় মাস আগেও প্রতিদিন তৈরি হতো টনকে টন বোর্ড কাগজ। এখন এই উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। কাগজ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং পুরোনো কাগজ থেকে বোর্ড কাগজ তৈরিতে কয়েক হাজার শ্রমিক জড়িত। এদের অনেকেই ব্যবসা মন্দার কারণে হয় ছাঁটাইয়ের কবলে কিংবা ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন।
বগুড়ায় কাগজ প্রক্রিয়াজাত শিল্পের একটি ইতিহাস আছে। ২০০৯ সালে প্রথম ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের টিএমএসএসের প্রধান কার্যালয়-সংলগ্ন এলাকায় গড়ে ওঠে বিসিএল পেপার মিলস। এর সাফল্য দেখে অন্যান্য উদ্যোক্তা কারখানা স্থাপনে আগ্রহী হন।
আমিনুল নামের এক উদ্যোক্তা বলেন, গ্রামের মানুষের কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতেই শহর থেকে প্রায় ১৫-২০ কিলোমিটার দূরে এসব কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। এখন ব্যবসা মন্দা থাকায় অনেক কারখানাই বন্ধ রাখা হয়েছে।
এরুলিয়া এলাকার ক্ষুদ্র পেপার মিল ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকার গ্রামগঞ্জের এই শিল্পটির দিকে নজর দিচ্ছে না। এসব কারখানায় গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ দিয়ে চালানোয় উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছে।
মকবুল নামের একজন বলেন, শহরের কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করতে পারলে গ্রামের কারখানায় কেন করা যাবে না? একসময় বগুড়া ছিল উত্তরাঞ্চলের প্রধান শিল্পশহর এবং সেখানে অনেক বড় বড় কারখানা ছিল। কিন্তু গ্যাসভিত্তিক কারখানার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে সেখানকার অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণেই উদ্যোক্তাদের দাবি গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত এই স্বল্প পুঁজির কারখানাগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহ করা হোক।
পুরোনো বা টোকানো কাগজ থেকে বোর্ড তৈরির কারিগর, মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে বেড়েছে টোকানো কাগজ থেকে বোর্ড কাগজ তৈরির কারখানা। বোর্ড কাগজ তৈরির কারখানাগুলোতে আগের শ্রমিক ছিল বেশি। এখন এই সংখ্যা কমে গেছে। এসব কারখানায় বড় কাগজের জোগান দেয় বিভিন্ন ছাপাখানা ও পত্রিকা অফিস।
বগুড়া জেলা থেকে প্রতিদিন দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ হয় ১৮টি। এর সঙ্গে সাপ্তাহিক প্রকাশ হয় চারটি। বগুড়ায় রয়েছে উত্তরের ১৬ জেলার সবচেয়ে বড় প্রেসের ব্যবসা। পাঁচ শতাধিক প্রেসে প্রতিদিনের টককে টন কাগজের কাজ হয়। পুরোনো খবরের কাগজ, প্রেসপট্টির ছাট কাগজ, বাসাবাড়ি থেকে সংগৃহীত পুরোনো বই, কাগজ ও ছিন্নমূল মানুষদের টোকানো কাগজ ক্রয় করে কারখানায় নিযুক্ত শ্রমিকরা। আগে টোকানো সাদা কাগজ ৬ থেকে ৮ টাকা আর নিউজ জাতের কাগজ ৪ থেকে ৬ টাকা কেজিতে কেনা হতো। প্রেসের সাদা কাগজ মান অনুযায়ী ২০ থেকে ২৮ টাকা, নিউজ ও রঙিন কাগজ ৮ থেকে ১০ টাকা কেজিতে কেনা হতো। এখন এই দাম দুই থেকে তিনগুণ বেড়েছে।
টোকানো কাগজ থেকে বোর্ড তৈরির শ্রমিক আব্দুল্লাহ মামুন জানান, কাগজগুলো কেনার পর সেটি বিশেষ হাউজে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। হাউজে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখাটা এক ধরনের কৌশল থাকে। শুরুর দিকে হাউজে পানি দিয়ে কাগজগুলো পা দিয়ে খুঁচিয়ে নরম করা হতো বা মণ্ড তৈরি করা হতো। এখন এ কাজটি মেশিন দিয়ে করা হয়। এরপর সেই মণ্ড মেশিনের মাধ্যমে একটি ট্যাংকিতে নেওয়ার পর বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে কাগজের মেশিনে নেওয়া হয়। সেখানে ৪ থেকে ৫ জন শ্রমিকের সাহায্যে পানি নিচে ফেলে দেওয়া হয়। কাগজের স্তর একটি বিশেষ স্থানে জমা হয়। সেটি তুলে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপর অর্ডার মতো কাটিং, সরবরাহ করা হয়।
বগুড়া সদরের বারোপুর সড়কের বোর্ড কাগজ তৈরির শ্রমিক আফজাল সরকার জানান, পুরোনো কাগজ থেকে কিছু কাগজ বাছাই করে নিয়ে তারপর সেটি দিয়ে নতুন বোর্ড কাগজ তৈরি করা হয়। ৮ আউন্স বোর্ড থেকে শুরু করে ৩২ আউন্স মোটা বোর্ড তৈরি করা হয়। এসব বোর্ড দিয়ে বই-খাতার কাভার, পণ্যের মোড়ক তৈরি করা হয়।
বগুড়া শহরের কারবালা মোড়ের পুরোনো কাগজ থেকে নতুন বোর্ড তৈরির কারখানার মালিক আব্দুল আউয়াল জানান, এই শিল্প স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের খরচ কমিয়ে আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। মলাট হিসেবে এর ব্যবহার বেশি। বগুড়ায় ১৮ থেকে ২০টির মতো কারখানা রয়েছে। এই কারখানায় তৈরি করা বোর্ড কাগজগুলো উত্তরের সব জেলায় ব্যবহার হয়। আগে এই বোর্ড ঢাকা বা খুলনা বা বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হতো। বগুড়ায় তৈরির কারণে সময় বাঁচার সাথে সাথে স্থানীয়ভাবে আর্থিক উন্নয়ন হতো। সুযোগ হয়েছিল এসব কারখানায় ছিন্নমূল মানুষের টোকানো কাগজ, প্রেসের ছাট কাগজ, পুরোনো খবরের কাগজ ব্যবহার করে বোর্ড কাগজ তৈরির। বর্তমানে অস্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে এই শিল্পটি ঝুঁকির মধ্যে। তার মতে, কাগজের এই কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখলে এবং সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এই অঞ্চলে বড় প্রতিষ্ঠান গড়া যাবে।
বগুড়া শহরের প্রেসপট্টির ব্যবসায়ী রাসেল জানান, বই বাঁধাই করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বোর্ড কেনা হয়। ঢাকায় তৈরি একটি ২৪ আউন্সের বোর্ডের দাম বেশি পড়ে। বগুড়ার লোকাল বোর্ডের দাম পড়ে মান অনুযায়ী ২৬ থেকে ৩২ টাকা। বগুড়া শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে পুরোনো কাগজ দিয়ে তৈরি হচ্ছে এই বোর্ড। এই বোর্ডের স্থানীয় চাহিদাও আছে বেশ। কুটির শিল্প হিসেবে এই শিল্পের প্রসার যেমন ঘটছে তেমনি প্রয়োজন মেটাতে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এখন সবকিছুর দাম বাড়ার কারণে ৩২ টাকার বোর্ডের দাম হয়েছে ৫৬ টাকা।
বগুড়া শহরের নামী ছাপাখানা নিউজ কর্ণার পাবলিশিংয়ের মালিক কালিপদ সেন টিপু জানান, কাগজ ছাপানোর পর সেটি চাহিদামাফিক কাটিং করা হয়। কাটিং করার টুকরো কাগজগুলো আগে ফেলে দিতাম ময়লা হিসেবে। কিন্তু এখন সেটির ব্যাপক চাহিদা। এখন সেটি কেজিদরে বিক্রি হয়। এই কাগজ দিয়ে মেশিনের মাধ্যমে আবারো বোর্ড কাগজ তৈরি করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এক অর্থে ফেলনা কাগজ দিয়ে নতুন করে এখানেই আবার বোর্ডের কাজ করা হচ্ছে। বগুড়া শহরের তালুকদার শপিং মার্কেট, প্রেসপট্টি, বাইন্ডিং পট্টি, শাপলা মার্কেটে এই কাগজ বিক্রি হচ্ছে।
এসএইচএস/এএসএম