ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

টাকা নেই কৃষকের হাতে, বন্ধের পথে বহু খামার

আমিন ইসলাম জুয়েল | প্রকাশিত: ১২:৩১ পিএম, ১২ নভেম্বর ২০২২

উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে দেশের কৃষিখাতেও। উৎপাদন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের মজুরি যেমন বাড়ছে, কৃষি উৎপাদন উপকরণও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। এরমধ্যে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং। যার তাণ্ডবে দেশের অনেক অঞ্চলে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে কৃষকের ফসল। সর্বোপরি সরাসরি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকরা বাজারে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। এতে লোকসানের আশঙ্কায় কৃষকের কপালে পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা পাবনার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, মূলধনের অভাবে বড়-ছোট অনেক খামার বন্ধ হওয়ার পথে। কৃষকরা কৃষি প্রণোদনা তথা সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ পাচ্ছেন না। অনেক প্রতিষ্ঠিত খামারিও ঋণখেলাপির জালে আটকা পড়ছেন। তাদের কেউ কেউ ব্যাংকের মামলা মাথায় নিয়ে ঘরছাড়া। সেসব এলাকার কৃষক ও খামারিরা মনে করছেন, ব্যাংকগুলো সহায়তার হাত বাড়ালে এবং সরকার প্রণোদনা দিলে তবেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরা সম্ভব।

পাবনার বেশ কিছু শীতকালীন ও বারোমাসি সবজির মাঠ, মুরগির খামার, গরুর খামার, মাছের খামার ঘুরে দেখা গেছে, অনেকে সীমিত পরিসরে উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ তা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কৃষক ও খামার মালিকরা বলছেন, উৎপাদন খরচের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া পণ্যের ন্যায্যমূল্যও পাচ্ছেন না তারা। অনেকে আগামী মৌসুমে পেঁয়াজ ও ধান চাষ ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। পুঁজি সংকটে পড়া অনেকে চাইছেন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

আরও পড়ুন: চলতি অর্থবছরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্য ৩০৯১১ কোটি টাকা

সদর উপজেলার প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি সমিতির আহ্বায়ক হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের সহজ শর্তে ঋণ না দিলে টিকে থাকা অসম্ভব।

স্থানীয় গরুর খামারিদের অনেকে বলছেন, গো-খাদ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। উৎপাদন খরচ মেটাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। মৎস্য চাষিদের কথায়ও একই সুর। ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে খামার পরিচালনা তাদের পক্ষে দুরূহ।

চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় শুধু প্রান্তিক বা মধ্যবিত্ত চাষিরা ক্ষতির মুখে ছিলেন। কিন্তু এখন উচ্চবিত্ত চাষিরাও ক্ষতির আশঙ্কা করছেন। সরকারের কোনো প্রণোদনা না পেলে বড় খামারিরাও উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারেন। উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় পুঁজির সংকটে এরই মধ্যে বেশ কিছু খামার বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন তারা।

চাষিদের কেউ কেউ আক্ষেপ প্রকাশ করে জানান, জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত অনেক চাষি ক্ষতির মুখে পড়ে ব্যাংক ঋণ খেলাপির তালিকায় চলে গেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকে পালিয়ে ফিরছেন। অথচ তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করা হলে তারা দ্রুত ঘুরে দাাঁড়াতে পারবেন।

আরও পড়ুন: ডিসেম্বর পর্যন্ত কৃষিঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ

তাদের অভিযোগ, এক শ্রেণির অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য প্রকৃত চাষিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। চাষিরা হাত গুটিয়ে নিলে কৃষি উৎপাদনে ভাটা পড়বে। দেশে খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দেবে। একই অবস্থায় পড়েছেন নতুন চাষি তথা নারী উদ্যোক্তারাও।

চাষিরা বলছেন, সরকারি ঘোষণা আর ব্যাংকগুলোর ঋণ দেওয়ার মধ্যে ফারাক আছে। সরকার বলছে বর্গা চাষিরা জামানত ছাড়া ঋণ পাবেন। কিন্তু ব্যাংক তা দিচ্ছে না। এমনও হচ্ছে, কৃষকের জন্য দেওয়া সরকারি প্রনোদনার ঋণ ব্যবসায়িরা নিয়ে নিচ্ছেন। কৃষকের প্রকৃত খবর জানে কৃষি বিভাগ। কৃষি বিভাগের সুপারিশের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে কৃষকের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা দরকার। এক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যেন কৃষি বিভাগের পরামর্শ মানতে বাধ্য থাকে সে নিয়ম করা জরুরি। দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষকরাই তো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করছেন। তাই খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় এবং সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের কথা মাথায় রেখে কৃষককে আগে আগে বাঁচাতে হবে।

পাবনার ফরিদপুর উপজেলার রতনপুর গ্রামের দুগ্ধ খামারি হযরত আলী জাগো নিউজকে জানান, বাপ-দাদার আমল থেকে তারা গরুর খামার করেন। গাভী পালন করে তাদের সংসারে উন্নয়নও হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তারা লাভের মুখ দেখতে পারছেন না। ফলে খামার ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। স্বল্প সুদে ঋণ পেলে তাদের পৈত্রিক খামারটি টিকিয়ে রাখা যাবে।

জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের স্বনামধন্য মাছ চাষি এবং মৎস্য চাষে আনসার-ভিডিপি স্বর্ণপদক পাওয়া হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, তিনি দীর্ঘ তিন যুগ ধরে মাছ চাষ করছেন। তাদের মত বৃহৎ চাষিরাই মাছ উৎপাদন করে দেশে আমিষের চাহিদার বড় অংশ পূরণ করছেন। অথচ বর্তমানে খামারে প্রতিদিন যে খাবার দিতে হয় সেটির হিসাবে করলে মাছে চাষে লাভ বলে কিছু থাকছে না। এ সংকট নিরসন না হলে দেশে মাছ চাষেও মুখ ফিরিয়ে নেবে অনেকে। সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ব্যাংকগুলো সে অনুযায়ী কৃষকদের প্রণোদনা বা ঋণ দিচ্ছে বলেও অভিযোগ তার।

স্থানীয মৎস্য খামারের মালিক আবু তালেব জোয়ার্দার বলেন, মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছ চাষে লাভ আগের মতো নেই। নগদ টাকার অভাবে খামার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। সরকার প্রনোদনা ঘোষণা করলেও তা আমাদের হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বলছে, তারা মর্টগেজ হিসেবে পুকুরের জমি নেবে না। তবে কি আমরা সেই জমি বন্ধক রাখবো? এ বিষয়ে সরকারের সুনজরদারি প্রত্যাশা করেন তিনি।

আরও পড়ুন: করোনার ক্ষতি কাটাতে না পারলেও ঋণ পরিশোধে এগিয়ে কৃষক

পাবনার নারী কৃষি উদ্যোক্তারাও জানিয়েছেন হতাশার কথা। জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার পাওয়া চাষি ও পাবনার অন্যতম নারী উদ্যোক্তা বেইলি বেগম জাগো নিউজকে জানান, তার ব্যক্তিগত ৩০ বিঘার খামারসহ তার স্বামীরও খামার রয়েছে। নগদ অর্থের অভাবে এবং উৎপাদন ব্যয় বাড়ায় তাদের খামারগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। তিনি মনে করেন, এক্ষেত্রে সীমিত সুদে পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণই হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র বিকল্প পন্থা।

বেইলি বেগম জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তার খামার পরিদর্শন করে ২০১১ সালে বলেছিলেন, তাদের জামানতাবহীন ২৫ লাখ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে। অথচ জামানত দিয়েও ঋণ পাওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন এই নারী উদ্যোক্তা।

বাংলাদেশ কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কারপ্রাপ্ত পাবনার খ্যাতিমান চাষি ময়েজ উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, নানামুখী বিপর্যয়ের কারণে আমি নিজেও ঋণ খেলাপি ও মামলার শিকার। কৃষি উৎপাদন উপকরণের দাম বাড়ছে। কিন্তু কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। তারা ক্ষতিগ্রস্ত। চাষিদের অনেকে পরবর্তী মৌসুমের চাষের পুঁজি হারাচ্ছেন।

তিনি জানান, প্রতিষ্ঠিত ও বৃহৎ চাষিরাও নগদ অর্থের সংকটে ভুগছেন। চলতি মূলধনের অভাবে অনেকের খামার মহামন্দার কবলে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দেওয়ায় চাষিরা ঠিকভাবে খামার পরিচালনা করতে পারছেন না। অনেক খামার বন্ধ হওয়ার পথে। তাদের কৃষি সংগঠন কৃষক উন্নয়ন সোসাইটির মাধ্যমে দেশের ৬৪টি জেলার জেলা প্রশাসককে এ ব্যাপারে স্মারকলিপি দেওয়া হলেও এখানো কোনো সুফল মেলেনি।

চাষি আব্দুল বারী ওরফে কপি বারী জানান, কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের জরুরি ভিত্তিতে আলোচনায় বসা দরকার। সংকট উত্তরণে করণীয় নির্ধারণ জরুরি। কেউ কোথাও চাষিদের কথা বলছেন না। এমনকি চাষিদের কথা কেউ শুনতেও চাইছেন না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক ড. সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, চাষিদের ক্ষুদ্র পরিসরে সার-বীজ ও কৃষি প্রণোদনার টাকা দেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যাংক ঋণের বিষয়টি তাদের আওতাভুক্ত নয়। পাবনার চাষিদের সহায়তায় পর্যাপ্ত ব্যাংক ঋণ দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

আমিন ইসলাম জুয়েল/এমকেআর/এএসএম