মিনিকেট ধান আছে বলছেন কৃষক-ব্যবসায়ীরা, মানতে নারাজ কৃষি বিভাগ
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, বাজারে মিনিকেট নামে কোনো চাল বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু মিনিকেট নামে কোনো ধান আছে কি না বা বাংলাদেশে এই ধানের চাষ হয় কি না তা তিনি বলেননি। সে কারণে দেশের মানুষ আছে বিভ্রান্তির মধ্যে।
এই বিভ্রান্তির বাইরে নেই খোদ সাংবাদিকরাও। মিনিকেট ধান এবং চাল নিয়ে কৃষক, কৃষি বিভাগ এবং ব্যবসায়ীদের নিয়ে অনুসন্ধান করে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন মিনিকেট ধান রয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ এটা মানতে নারাজ। কিন্তু বাজারে এখনও বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট চাল। তাহলে এই মিনিকেট ধান বা চাল আসলো কোথা থেকে।
আসলে এই ধানের নাম কি? মিনিকিট, মিনিকেট, মিনিকাট, মিনি প্যাক নাকি অন্যকিছু। এই প্রতিবেদনে সে কথাই জানা যাবে।
অনুসন্ধান করতে গিয়ে কথা হয় দিনাজপুর জেলার সদর উপজেলার ১০ নং কমলপুর ইউনিয়নের কুতইর গ্রামের কৃষক আব্দুর রহমানের সঙ্গে। তিনি একজন শিক্ষিত, দক্ষ, সচেতন সফল কৃষক।
কোথা থেকে আসলো, কীভাবে নাম হলো মিনিকেট
কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, ১৯৮৬ এবং ১৯৮৮ সালে যখন ভয়াবহ বন্যা হয় তখন ভারতের উত্তর দিনাজপুর জেলায় এবং বাংলাদেশে রোপা আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। সে সময় ভারত সরকার থেকে সে দেশের কৃষকদের কাছে ছোট ছোট প্যাকেটে চাষ করার জন্য ধান বীজ ও সার দেয়া হয়েছিল। সেই ধান বীজের নাম ছিল শতাব্দী। সেই থেকে পশ্চিম বাংলায় এই ধানকে মিনিকিট ধান বলা হয়। মিনিকিট নামে বর্তমানে পশ্চিম বাংলায় ১৭টি জাত রয়েছে। আশির দশকে সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক চোরাচালান হতো। তখন এই ১৭টি জাতের মধ্যে একটি জাত চোরাপথে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার কৃষকের কাছে পৌঁছে যায়। এই মিনিকিট ধানকে বাংলাদেশের কৃষকরা নাম দেন মিনিকেট।
ব্যবসায়ীরাও কৃষকের দেওয়া নামেই ধান কিনে চাল উৎপাদন করে মিনিকেট নামে বাজারে বিক্রি শুরু করে, যা শতাব্দী’র ১৭টি জাতের মধ্যে IET4786 জাতের ধান। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শতাব্দী’র ১৭টি জাতকে মিনিকিট এবং বাংলাদেশে যে একটি জাত এসেছে সেটিকে মিনিকেট নাম দিয়েছে কৃষক। মাঝখানে যখন অটোরাইস মিলগুলো হতে শুরু করল তখন কিছু ব্যবসায়ী আবার এই মিনিকেট চালকে মিনিকাট বলে বিক্রি করা শুরু করলেন। সে সময় কে বা কারা গুজব ছড়িয়ে দেয় চাল ছেঁটে ছোট করে বাজারে মিনিকেট চাল বিক্রি করা হয়। আসলে এটা সম্পূর্ণ গুজব। এই ধানের চালের ভাত খাননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ এখন বলা হচ্ছে এ নামের ধান নেই- চাল আছে। কতই না হাস্যকর। আমাদের কৃষি দফতরের কাছে ওপেন চ্যালেঞ্জ এই ধানের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য। বাস্তব কথা হচ্ছে মিনিকেট নামে ধানের নিবন্ধন নেই ভারত বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বের কোথাও। যেহেতু একটি ধান দেশে চাষ হচ্ছে সেহেতু নিবন্ধন দিলে অসুবিধা কোথায়।
আব্দুল রহমান আরও জানান, পশ্চিম বাংলার দুজন কৃষি অফিসারের সঙ্গে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপার বাংলার উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দপ্তরের একজন কর্মকর্তা দেবাশীষ দত্ত ও জয়ন্ত সেনের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করেছেন।
কৃষক আব্দুল রহমান (Abdur Rahman) নামের ম্যাসেঞ্জার থেকে করা প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন দেবাশীষ দত্ত তার (Debasish Dutta) ফেসবুক আইট থেকে লিখেছেন, “মানে ৩৩ ডেসিমেলের বিঘায় ৩৩ মণ? ভাই আপনি ভাগ্যবান। আপনার বাড়ি দিনাজপুরের কোথায়? আর বোরো চাষে স্বল্প খরচে? আমি এপার বাংলায় উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দপ্তরে চাকরি করি। এই IET4786 (Satabdi) জাতটি পুরোনো। এখানে এত ফলন হয় না। আরেক অফিসার জয়ন্ত সেন (Jayanta Sen) লিখেছেন, ভাই মিনিকিট নামে পশ্চিম বাংলায় বর্তমানে ১৭টি জাতের ধান চলে, তবে ভারতে সরকার থেকে চাষিদের ছোট ছোট প্যাকেটে যে ধরনের বীজ চাষ করার জন্য দেওয়া হয়েছিল সেটির জাতের নাম IET4786, ছোট প্যাকেটে দেওয়া হয়েছিল বলে এটিকে মিনিকিট বলা হয়েছিল, ফলে চাষিদের কাছে এটা মিনিকিট নামেই চালু হয়ে গেছে। একই কথা বলেন ওই এলাকার অনেক চাষি।
চাল ব্যবসায়ীরা যা বলছেন
এ বিষয়ে কথা হয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সহিদুর রহমান পাটোয়ারী মোহনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা কোনো ধান উৎপাদন করেন না। ব্যবসায়ীরা কৃষকের কাছে ধান কিনে চাল উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করে। কৃষক বাজারে ধান নিয়ে এসে যে নাম বলে সে নামেই ব্যবসায়ীরা ধান কিনে চাল উৎপাদন করে সে নামেই বিক্রি করে। মিনিকেট ধান আছে কি না সেটা কৃষক ও কৃষি বিভাগের বিষয়। তবে বাজারে খরার মৌসুমে অর্থাৎ ইরি-রোরো মৌসুমে এই নামে ধান বাজারে ব্যাপক বিক্রি করেন কৃষকরা।
যেহেতু ধানটির চাষ হচ্ছে সেহেতু নিবন্ধন চান কৃষক-ব্যবসায়ীরা-ছবি জাগো নিউজ
মিনিকেট ধান আছে কি না এ নিয়ে বিএফএসএ ১৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি
সাধারণ মানুষ ও কর্তাব্যক্তিদের একটা ধারণা রয়েছে, মোটা চাল কেটে মিনিকেট চাল তৈরি করা হয়। এ নিয়ে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. ইকবাল রউফ মামুনকে প্রধান করে ১৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই টিম মিনিকেট মোটা চাল কেটে তৈরি করা হয় কি না, এর কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে কি না- তা যাচাই করে কমিটি একটি গবেষণা প্রতিবেদন জমা দেয়।
ফলাফল অংশে লেখা হয়েছে
১. মিলগুলো বিআর-২৮, বিআর-২৯ ও অন্যান্য জাতের ধানকে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ছাঁটাই করে মিনিকেট তৈরি করে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
২. মিনিকেট বা পলিশ করা চাল খেলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকির কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই।
৩. পরিমাণে কম হলেও বোরো মৌসুমে মিনিকেট নামেই ধান চাষ হয় তা প্রতিবেদনের নথিতে (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ধানের জাতের নথি) সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগ কী বলছে
মিনিকিট, মিনিকেট, মিনিকাট, মিনি প্যাক আসলে কোনটি ঠিক। নাকি এ নামের কোনো ধান নেই। এমন প্রশ্নে কোনো কৃষি কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাঠ পর্যায়ের এক প্রবীণ কর্মকর্তা বলেন, মিনিকেট নামে যে ধান বা চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে তার তো একটা নাম আছে নিশ্চয়ই। যেহেতু নিবন্ধন নেই তাই কৃষি অধিদপ্তরের পক্ষে এটা মিনিকেট ধান তা স্বীকার করা কঠিন। কিন্তু ধানটি যেহেতু পাওয়া যায় তাহলে তো একটা নাম দিলেই হয়। সব ধান তো আর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবন করেনি। হরিপদ কাপালি তো কোনো বিজ্ঞানী ছিলেন না। তার ধানের যদি নাম দেওয়া যায় তাহলে এই ধানেরও গবেষণা করে নাম দেওয়া উচিত।
এই ধান চেনার উপায়
ধানটি চিকন ও লম্বা। ২৮ জাতের ধানের মতো। তবে নিচের দিকে ধানটি ধনুকের মতো কিছুটা বাঁকা। কী পরিমাণ জমিতে এই ধান চাষ হয় তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কৃষকরা জানিয়েছেন, এই ধানের চাষ অনেক কমে গেছে। বাজারে ব্রি-২৮, ব্রি-২৯ জাতের যে ধানগুলো রয়েছে সে ধানের চাল বাজারে মিনিকেট বলে বিক্রি করা হচ্ছে।
এসএইচএস/জেআইএম