বাংলাদেশে নতুন তিমির সন্ধান
<> এটি আকারে ডলফিনের চেয়ে ছোট; অনেকটা হাঙরের মতো
<> গত ২২ মে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে নতুন প্রজাতির এ তিমির দেখা মেলে
<> জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হলেও এটি পরে মারা যায়
<> গবেষকদের ধারণা, প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ খেয়ে তিমিটির মৃত্যু হতে পারে
তিমির কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে বড় আকারের একটি সামুদ্রিক প্রাণীর ছবি। তবে ডলফিনের চেয়ে আকারে ছোট আর হাঙরের মতো দেখতে কোনো প্রাণীকে যদি তিমি বলা হয় তাহলে বিষয়টি একটু হলেও কৌতূহল জাগাবে। তবে বাংলাদেশে এমনই এক তিমির সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। নতুন প্রজাতির এই তিমির নাম ‘বামন কোগিয়া’।
গত ২২ মে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে নতুন প্রজাতির এ তিমির দেখা মেলে। সমুদ্রের তীরবর্তী এলাকায় জীবিত অবস্থায় তিমিটির দেখা পান কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্যরা। পরে বারবার পানিতে নামানোর চেষ্টা করেও একে বাঁচানো যায়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা ছটফট করে তিমিটি মারা যায়।
পরে তিমিটি কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটি, বনবিভাগ ও ইকো-ফিশ যৌথ উদ্যোগে সংরক্ষণ করে গবেষণা করে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)।
কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির টিম লিডার রুমান ইমতিয়াজ তুষার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণ বর্ষা মৌসুম এলে কুয়াকাটা সৈকতসহ তীরবর্তী এলাকায় ডলফিন, তিমি, কচ্ছপ, রাজ কাঁকড়ার দেখা মেলে। এগুলো অনেক সময় জীবিত আবার অনেক সময় মৃত পাওয়া যায়। তবে গত ২২ মে যে তিমিটি জীবিত অবস্থা পেয়েছি এটিকে প্রাথমিকভাবে সমুদ্রে নামিয়ে আমরা বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু বারবার নামিয়ে দেওয়া হলেও প্রতিবারই তিমিটি তীরে চলে আসে। পরে প্রায় দুই ঘণ্টা ছটফট করে প্রাণীটি মারা যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে যতগুলো ডলফিন ভেসে এসেছে সেগুলো থেকে এটিকে একটু ভিন্ন মনে হয়েছিল আমাদের কাছে। তাই জাত শনাক্ত করতে আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। পরে ডব্লিউসিএসের কাছে আমরা স্যাম্পল পাঠিয়ে দেই। গবেষণা শেষে আমরা নিশ্চিত হই যে এটি একটি নতুন প্রজাতির তিমি।’
পটুয়াখালী জেলা ইউএস-এইড/ ইকোফিশ-২ ও ওয়ার্ড ফিশ বাংলাদেশ প্রকল্পের সহযোগী গবেষক সাগরিকা স্মৃতি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটি সংরক্ষণের জন্য আলীপুর মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জেলেদের সামনে প্রদর্শন করা হয়। তখন স্থানীয় জেলেদের সঙ্গে কথা বলে ও বিগত দিনে কুয়াকাটা সৈকতে যে ডলফিনগুলো ভেসে এসেছে তার অভিজ্ঞতা থেকে মোটামুটি আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে এটি সাধারণ কোনো ডলফিন বা তিমি নয়। পরে স্যাম্পলের (নমুনা) ওপর গবেষণা করে এর জাত নিশ্চিত হওয়া যায়।’
তিনি আরও বলেন, তিমিটি বনবিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর পেটে দুটি বাচ্চা পাওয়া গেছে। বাচ্চা দুটির ওপর পরীক্ষা করে যানা যাবে যে আসলে প্রজননের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে তিমিটি মারা গেছে।’
প্রাথমিকভাবে ছবি ও ভিডিও দেখে ও পরে তিমিটির কান, লেজ, চর্বি, মাংস ও পেটের ভেতরের অংশ পরীক্ষার মাধ্যমে ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি বাংলাদেশের গবেষকরা চিহ্নিত করেন এটি ‘বামন কোগিয়া’ প্রজাতির তিমি।
গবেষক দলের সদস্য ও ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সিনিয়র সমন্বয়ক নাদিম পারভেজ জাগো নিউজকে বলেন, বিজ্ঞানীদের কাছে কোগিয়া সিমা নামে পরিচিত এই তিমিটি প্রাথমিকভাবে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়। তবে এর ছবিগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে নিয়োজিত কর্মীদের কাছে খুবই আশ্চর্যজনক ছিল। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে প্রথম এই প্রজাতির তিমির রেকর্ড নিশ্চিত করা হয়।
তিনি বলেন, ‘এ তিমির দৈহিক গঠন এ রকম যা মোটেই কাকতালীয় বিষয় নয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহার করে বামন কোগিয়া তিমি তাদের শিকারি প্রাণী যেমন ঘাতক তিমি ও বড় হাঙরদের এভাবে বোকা বানায় যে সে আসলে একটি হাঙর।’
‘তিমিটির শরীরের বিভিন্ন অংশ গবেষণা করে দেখতে পাই যে, এদের পেটের ভেতরে অন্ত্রের সঙ্গে লালচে-বাদামি তরলে ভরা একটি ছোট থলি সংযুক্ত থাকে। শিকারিদের উপস্থিতিতে এরা থলি থেকে তরল পদার্থ পানিতে ছুঁড়ে দেয় এবং নিজেদের আড়াল করে। বিষয়টি আসলে অক্টোপাসের মতো যারা কিনা ভয় পেলে কালির মতো কালো তরল নির্গত করে। তবে এরা হলো বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম তিমি, তাই অন্যান্য বিশালাকার তিমির মতো আকার দিয়ে এরা শিকারি প্রাণীদের ভয় দেখাতে পারে না’, যোগ করেন ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির এ সদস্য।
ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা কর্মকর্তা রাসেল মিয়া জাগো নিউজকে জানান, বিশ্বে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ৯০টিরও বেশি প্রজাতির সেটেশানদের (প্রাণীগোষ্ঠী) মধ্যে বামন কোগিয়া তিমি একটি। সেটেশানরা আমাদের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা তাদের সারাজীবন পানিতে কাটায় এবং বাতাস থেকে শ্বাস নেয়। মানুষের মতোই মা সেটেশানরা সাধারণত একটি বাচ্চা বা শাবক জন্ম দেয়, যারা স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে সক্ষম হওয়ার আগ পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। ডলফিন, পরপয়েস এবং বামন কোগিয়াসহ আরও কয়েকটি দাঁতাল তিমিদের ধারালো দাঁত থাকে যা দিয়ে তারা পিচ্ছিল শিকার ধরে ও মুখে পুরে নেয়। তবে অন্যান্য সব সেটেশানদের মতো এরা শিকারকে চিবিয়ে না খেয়ে সম্পূর্ণ গিলে ফেলে।
তিনি আরও জানান, মূলত সেটেশানদের একটি শক্তিশালী লেজপাখনা থাকে যা ফ্লুক নামে পরিচিত। সেটেশানরা লেজপাখনা ওপরে-নিচে নাড়ানোর মাধ্যমে সামনের দিকে চলে, দুটি পার্শ্বপাখনা ব্যবহার করে সাঁতার কাটে এবং পিঠপাখনা ব্যবহার করে দেহের ভারসাম্য ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
বাংলাদেশে বামন কোগিয়া তিমি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ডব্লিউসিএস বাংলাদেশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে বাসকারী এ তিমি সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। যদিও, বাংলাদেশের সমুদ্রে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ডব্লিউসিএস পরিচালিত গবেষণার সময় এ প্রজাতিটি কখনও দেখা যায়নি। তবে বামন কোগিয়া তিমি আমাদের ধারণার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকতে পারে। কারণ, সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ সম্পূর্ণ শান্ত থাকলে এবং এরা সমুদ্রপৃষ্ঠে গতিহীনভাবে অবস্থান করলে এদের দেখা পাওয়া সম্ভব; অন্যথায় দেখা পাওয়া খুব কঠিন।’
তিমিটির মৃত্যুর কারণ প্রসঙ্গে গবেষকরা বলছেন, কোগিয়া প্রজাতির তিমি প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষকে ভুলবশত স্কুইড, অক্টোপাস বা ক্যাটলফিশ ভেবে গিলে ফেলে এবং মারা যায়। যে কারণে এরা আজ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষ এদের পরিপাকতন্ত্রকে অবরুদ্ধ করতে পারে এবং ফলস্বরূপ অনাহারে মৃত্যু ঘটতে পারে।
গবেষকরা আরও বলেন, বাংলাদেশের সৈকতে পাওয়া গর্ভবতী বামন কোগিয়া তিমিটির পেটে দুটি বাচ্চা ছিল। সেটেশানদের মধ্যে এ ঘটনা অত্যন্ত বিরল। কারণ সেটেশানরা সাধারণত প্রতিবারে একটি বাচ্চা জন্ম দেয়।
আসাদুজ্জামান মিরাজ/এসআর/জিকেএস