দেশের সবচেয়ে বড় পেঁয়াজের হাটে মণে কমেছে ৫০০ টাকা
গত সপ্তাহে হাটে পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দাম উঠেছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ। কিছুটা লাভের আশা করেছিলেন চাষিরা। কিন্তু চাষির সেই আশার গুড়ে বালি। কারণ সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম প্রতি মণে গড়ে ৫০০ টাকা কমে গেছে।
শনিবার (১৪) দেশের সর্ববৃহৎ পেঁয়াজের হাট বনগ্রামে সবচেয়ে ভালো মানের প্রতি মণ পেঁয়াজ এক হাজার থেকে সাড়ে ১১শ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। ফাটা পেঁয়াজ প্রতি মণ ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে। এতে চাষিরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বলে জানিয়েছেন।
তারা জানিয়েছেন, এক মণ ফাটা পেঁয়াজ বিক্রি করে এক লিটার সয়াবিন তেলের দামও হচ্ছে না।
সরেজমিনে বনগ্রাম হাটে গিয়ে দেখা গেছে, হাটভর্তি পেঁয়াজ। হাটে জায়গা না পেয়ে অনেক চাষি রাস্তার ওপরও পেঁয়াজের বস্তা রেখেছেন। পেঁয়াজ আমদানির অনুপাতে বাজারে চাহিদা নেই। ব্যাপারীরা বেশি পেঁয়াজ কিনতে উৎসাহী নন। ব্যাপারীদের ডেকে এনে চাষিরা পেঁয়াজ বিক্রি করছেন।
বেশ কিছু পেঁয়াজ চাষির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত দুই বছর পেঁয়াজ চাষিরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়লেও শেষ পর্যন্ত বাজারে ভালো দাম পেয়েছেন। এবার নিরাপদেই পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পেরেছেন তারা। তবে পেঁয়াজ মৌসুমে কয়েক দফায় ভারি বর্ষণ হওয়ায় পেঁয়াজ গাছ ফুলে ভরে গিয়েছিল। এতে অধিকাংশ জমির পেঁয়াজ ফেটে গেছে। ফাটা পেঁয়াজের দাম কম আবার তা ঘরেও রাখা যায় না। শনিবার হাটে এরকম ফাটা পেঁয়াজ ২০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
চরপাড়া গ্রামের বারেক সর্দার বলেন, তিনি ফাটা পেঁয়াজ বাজারে এনে বিপাকে পড়েছেন। সকাল ৬টায় হাটে এসে বেলা ১১টা পর্যন্ত পেঁয়াজ বিক্রি করতে পারেননি।
সুজানগর উপজেলার বামনদি গ্রামের পেঁয়াজ চাষি রফিকুল ইসলাম বলেন, পেঁয়াজের যে বাজার তাতে মণপ্রতি ৫০০-৬০০ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর ওপর যদি আবার পেঁয়াজ আমদানি করা হয় তাহলে চাষিরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
তিনি জানান, উৎপাদন খরচ যে হারে বেড়েছে তাতে প্রতি মণ পেঁয়াজ ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা হলে কিছুটা লাভ থাকত।
পেঁয়াজ ব্যাপারী রেজাউল করিম বনগ্রাম, আতাইকুলা, কাশীনাথপুর ও চিনাখড়া হাট থেকে পেঁয়াজ কিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, নারায়ণগঞ্জে সরবরাহ করেন।
তিনি জানান, মাত্র তিনদিনের ব্যবধানেই পেঁয়াজের দাম কমে গেছে। তাই ব্যাপারীরা পেঁয়াজ বেশি দামে কিনতে পারছেন না।
আতাইকুলা থানার গোসাইপাড়া গ্রামের হেলাল উদ্দিন জানান, যে পেঁয়াজ চারদিন আগে বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৫০০ টাকা মণ, সেই পেঁয়াজের এখন দাম বলছে এক হাজার ৫০ টাকা।
চাষিরা জানান, এবার পেঁয়াজ লাগানোর পর থেকেই অসময়ে কয়েকবার বৃষ্টি হয়। সে সময় অনেক জমিতে পানিও জমেছিল। ফলে এবার পেঁয়াজ গাছ ফুল দিয়ে ভরে গেছে। ফলে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। যে জমিতে বিঘায় ৬০-৭০ মণ ফলন হতো সেখানে এবার হয়েছে ৪০-৫০ মণ।
চাষিরা জানান, এবার প্রতি বিঘা পেঁয়াজের জমি বার্ষিক লিজ নিতে হয়েছে ১৫-২০ হাজার টাকায়। এতে চাষিদের বিঘাপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০-৫০ মণ। সে হিসাবে ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা মণে পেঁয়াজ বিক্রি করলে তাদের উৎপাদন খরচ উঠছে না।
কৃষি তথ্য সার্ভিস পাবনার আঞ্চলিক কৃষি তথ্য অফিসার ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার সরকার জানান, পাবনা জেলায় এবার ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। চাষের লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে গেছে। এবার পাবনা থেকে অন্তত সাত লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হবে বলে কৃষি বিভাগ আশাবাদী।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতি বছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন, যা মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের বেশি। পাবনা জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসাবে সারাদেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক-পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুটি উপজেলা থেকে।
বাংলাদেশ ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি আলহাজ শাহজাহান আলী জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বেচে ফেলতে হয়। বাধাইকারকরা বেশি দাম ধরতে পারে।
তিনি জানান, পেঁয়াজ চাষে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও সাধারণ চাষিরা সে সুবিধা পচ্ছেন না। তারা চড়া সুদে মহাজনী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল লতিফ জানান, পাবনা জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর দেশের পেঁয়াজের রাজধানী। দেশের এক-চতুর্থাংশের বেশি পেঁয়াজ পাবনা জেলায় জন্মে। কৃষি বিভাগ চাষিদের মৌসুমজুড়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
এফএ/জেআইএম