শিশু পরিবারের বাচ্চাদের নাতি-নাতনি মনে করে সময় কাটে আসমা বেগমের
৩৫ বছর আগে স্বামীর ওপর অভিমান করে সাত মাসের মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে আসেন আসমা বেগম। বাড়ি নওগাঁর মান্দা উপজেলার বলসিং গ্রামে। বাবার বাড়ি থেকেই মেয়ে জোসনাকে বড় করে বিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী মহাদেবপুর উপজেলায় সরকারি চাকরিজীবী জামাই দেখে। মেয়ে সুখেই আছে।
বয়স বাড়তে থাকে আসমার। এরমধ্যে ভাইয়েরা তার বাবার সম্পতি গোপনে লিখে নেয়। কিছুদিন পর তাকে বিতাড়িত করা হলে চলে যান মেয়ে জামাইয়ের কাছে। এভাবে কয়েক বছর কেটে যায়। মেয়ে তার মাকে কাছে রাখতে চাইলেও জামাই নারাজ। মেয়ে ও স্বজনদের অবহেলায় অবশেষে ২০১৯ সালের ৭ মে থেকে ঠাঁই হয়েছে সরকারি শিশু পরিবারে।
আসমা বেগম (৭৭) জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাবার সম্পত্তি ভাইয়েরা গোপনে লিখে নেওয়ার পর সেখানে আর আমার জায়গা হয়নি। ভাই ও ভাতিজা সবাই তাড়িয়ে দিলে চলে যায় মেয়ের কাছে। জামাইও আমাকে রাখলো না। পরে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে সরকারি জায়গায় একটা ঘর দেওয়ার জন্য আবদার করলাম। তিনি আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
শিশু পরিবারে থাকা, খাওয়া, ওষুধপত্রসহ সব ধরনের সুবিধা থাকার পরও মনে সুখ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজন, মেয়ে-জামাই সবাই বাড়িতে ঈদ করছে। আর আমি এখানে ঈদ করছি। ঈদের সকালে রুটি, সেমাই ও চটপটি খেয়েছি। স্বজনদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। মেয়ে মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায়। বাড়িতেই থাকতে চাইছিলাম। সবাইকে নিয়ে এক পরিবারে থাকবো, পাতিল (হাঁড়ি) মুছে খাবো তাও শান্তি। কিন্তু সুখ আমার কপালে জুটলো না। কেউ আমাকে রাখলো না। থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।’
জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়ে বৃদ্ধা আসমা বেগম বলেন, ‘সব হারিয়ে গেছে। আর কি চাইলে পাওয়া যাবে? যতদিন বেঁচে আছি আল্লাহ যেন আমাকে সহি সালামতে উঠিয়ে নেয়। মারা যাওয়ার পর যদি তারা মনে করে আমার মরদেহ নিয়ে যাবে, তাহলে নিয়ে যাবে। অন্যথায় এখানেই কবর দেবে।’
এই বয়সেও কারো সাহায্য ছাড়াই চলাচল করতে পারেন আসমা বেগম। সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় ওঠানামা করেন। থাকেন ২০৩ নম্বর কক্ষে। থাকার বিছানাও পরিপাটি করে গোছানো। আলনাতে সাজানো আছে জামা-কাপড়।
সময় কীভাবে কাটে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোরআন পড়ে আর ইবাদত করে। এছাড়া বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করে সময়ে কেটে যায়। তাদের নাতনিদের মতো মনে হয়। রমজানে তিনবার কোরআন খতম দিয়েছি।’
সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) সূত্রে জানা যায়, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ এখানে পদসংখ্যা ১৮ জন। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদসহ সাতটি পদ শূন্য রয়েছে।
সমাজ ও পরিবারের অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পারিবারিক আবহের বন্ধনে রাখতে দেশের প্রতিটি সরকারি শিশু পরিবারে বৃদ্ধাশ্রম খোলা হয়েছে। যেখানে তারা শিশুদের সঙ্গে থাকবেন এবং মনে করবেন তারাই নাতি-নাতনি।
জীবনের পড়ন্ত বয়সে এসে অনেকেই স্বজনদের অবেহেলার শিকার হতে হয়। এসব বয়স্ক ব্যক্তিদের কথা ভেবে সরকার ২০১৬ সালে ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে বয়স্কদের জন্য ১০টি শয্যার ব্যবস্থা করেছে শিশু পরিবারে।
নওগাঁয় সরকারি শিশু পরিবারটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭২ সালে। পরে ২০০৩ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় শহরের বালুডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের পাশে দুই একর জমির ওপর সরকারি শিশু পরিবার (বালিকা) গড়ে তোলা হয়। যারা শিশু পরিবারে থাকে তাদের বলা হয় নিবাসী। নিবাসীর সংখ্যা ৯০ জন এবং বৃদ্ধার সংখ্যা ১০ জনসহ মোট সদস্য ১০০ জন।
এখানে একটি পাঁচ তলাবিশিষ্ট আবাসিক ভবন, এক তলাবিশিষ্ট স্টাফ কোয়ার্টার (কর্মকর্তা) ও দুই তলাবিশিষ্ট স্টাফ কোয়ার্টার (কর্মচারী)। নিবাসীর পাশাপাশি ২০১৯ সালে ১০ শয্যার বৃদ্ধাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ পর্যন্ত দুজন বৃদ্ধা ভর্তি আছেন।
তাদের জন্য থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, পোশাক ও আনুষঙ্গিক সবকিছুর ব্যয় সরকার বহন করে। টেলিভিশন দেখা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে নাস্তা এবং দুপুর ও রাতে ভাতের ব্যবস্থা থাকে। পুষ্টিকর খাবার হিসেবে মাছ-মাংস, দুধ, ডিম ও সবজিসহ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
শিশু পরিবারে ঠাঁই হয়েছে আরেক বৃদ্ধা গীতা রানির। আগে সাপাহার উপজেলায় ভাসমান অবস্থায় ঘোরাঘুরি করতেন। এলাকার বাসিন্দা হিসেবে কেউ তাকে চেনে না। অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ছিলেন। তিনি অনেকটা মানুষিক ভারসাম্যহীন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে গতবছর তাকে শিশু পরিবারে ভর্তি করা হয়।
ছয় বছর বয়স পর্যন্ত রাজশাহী হোম কেয়ারে ছিল সুম্মা। এরপর নওগাঁ শিশু পরিবারে। বর্তমানে সে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। সুম্মা বলে, ‘এ ঈদে সুন্দর পোশাক পেয়েছি। সুন্দর জুতা ও কসমেটিক পেয়েছি। সালামি পেয়েছি ৪০০ টাকা। ঈদের দিনে সকালের নাস্তার পর নামাজ পড়েছি। এরপর ছোট-বড় সবাই মিলে গল্প ও নাচ-গান করে সময় পার করেছি।’
কথা হয় নওগাঁ সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) উপ-তত্ত্বাধায়ক (ভারপ্রাপ্ত) সাইদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এখানে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্কদেরও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এতে শিশুরা যেমন দাদি-নানির স্নেহ অনুভব করতে পারবে তেমনি বয়স্করাও নাতি-নাতনির অভাব পূরণ করতে পারবেন। এ পর্যন্ত দুজন বৃদ্ধাকে ভর্তি করা হয়েছে এবং তাদের লালন-পালন করা হচ্ছে।
শিশু পরিবারে শিশুপ্রতি প্রতি মাসে বরাদ্দ ৩ হাজার ৫০০ টাকা। বয়স্কদের জন্যও একই বরাদ্দ। খাবার থেকে শুরু করে পোশাক, চিকিৎসা সবকিছুর ব্যয় বহন করে সরকার। চিকিৎসার জন্য একজন খণ্ডকালীন চিকিৎসক আছেন।
তবে জনবল সংকট থাকায় কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানান উপ-তত্ত্বাধায়ক সাইদুর রহমানে। তিনি আরও বলেন, শিশু ও বৃদ্ধাদের কোটা পূরণে প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। যাতে করে তারা ভর্তি হতে পারেন।
এসআর/জেআইএম