মুন্সিগঞ্জে আবিষ্কৃত হলো অষ্টকোণাকৃতির আরেক বৌদ্ধস্তূপ
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বরে আরও একটি অষ্টকোণাকৃতির বৌদ্ধস্তূপ ও ধর্মচক্র আবিষ্কৃত হয়েছে। নবম ধাপে ছয় মাসের উৎখননে আবিষ্কৃত এই নিদর্শন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে বিরল। এটি প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ও দেশের প্রত্নক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি গবেষণা ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (১৬ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে আবিষ্কৃত প্রত্নস্থাপনাটি ঘুরে দেখেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ গবেষণা ও উৎখনন কাজের সংশ্লিষ্টরা। পরে এ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মুন্সিগঞ্জের নাটেশ্বরে ২০১৩ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হয় ৭০০ থেকে ১২০০ শতকের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ও নগরীর ধ্বংসাবশেষ। এরপর ধাপে ধাপে উৎখননে এলাকাটির মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রাচীন নগরীর রাস্তা, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, পিরামিড আকৃতির স্থাপনাসহ বহু প্রাচীন নিদর্শন। নবম ধাপে এবার ছয় মাসের উৎখনন কাজে মাটির প্রায় ১৪ ফুট নিচ থেকে আবিষ্কৃত হলো অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ ও ধর্মচক্র। দুষ্প্রাপ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ এই স্থাপনা বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গকে নির্দেশ করে। এর আগের চারটিসহ এ নিয়ে নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত অষ্টকোণাকৃতির স্থাপনার সংখ্যা দাঁড়ালো পাঁচে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- সদ্য আবিষ্কৃত পঞ্চম স্তূপটি আগের চারটি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের প্রায় অনুরূপ কিন্তু আগের স্তূপের আদি ও পরবর্তী পর্যায় অনেকটা অসম্পূর্ণ এবং অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল; ফলে আদি পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতি স্তূপটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়নি। কিন্তু এবারের পঞ্চম অষ্টকোণাকৃতির স্তূপে আদি পর্যায়ের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত হয়েছে কারণ পরবর্তী পর্যায়ের স্তূপটি ছিল খুবই ক্ষতিগ্রস্ত।
পঞ্চম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতি স্তূপের দেওয়ালের গাঁথুনি এখনো অপূর্ব মসৃণ, মনে হয় যেন আধুনিক সিরামিক ইটের গাঁথুনি। দেওয়ালের ইট, গাঁথুনি কাদা মাটির মর্টার হলেও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। একটি বর্গাকার ভিত্তির ওপর উলম্বভাবে ইট স্থাপন করে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার মতো ধর্মচক্র নির্মাণ করা হয়েছে। আগে আবিষ্কৃত প্রথম এবং চতুর্থ অষ্টকোণাকৃতির স্তূপে আদি পর্যায়ে ধর্মচক্রের আভাষ দেখা দিয়েছিল কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ দিয়ে আবৃত থাকায় সে রহস্য উন্মোচিত হয়নি। সদ্য আবিষ্কৃত পঞ্চম অষ্টকোণাকৃতি স্তূপের ধর্মচক্রটিতে আটটি স্পেক রয়েছে। ধর্মচক্রে সাধারণত ৪, ৬, ৮, ১০, ১২, ২৪ এমনকী ৩১টি পর্যন্ত স্পেকযুক্ত থাকে। প্রতিটি স্পেকের সংখ্যা বৌদ্ধধর্মে প্রতীকী অর্থে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।
বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী এখানকার মাটির নিচে আরও তিনটি একই ধরনের স্থাপনা থাকতে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। এখানকার উৎখনন কাজ শেষ হলে আর্কিওলজিক্যাল পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। যা পর্যটনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দাবি, ভারতবর্ষের সবচেয়ে বিকশিত বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতির চর্চার রূপ অতীশ দীপঙ্করের নেতৃত্বে সপ্তম থেকে ১২ শতকে বিক্রমপুরের এই নাটেশ্বরে ঘটেছে। প্রথম অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ পেয়েছি ২০১৩-১৪ সালের খননে, এরপর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থটি পেয়েছি। আমাদের যে গবেষণা ও চিন্তা চেতনা সেখান থেকে মনে হচ্ছে, পুরো এলাকায় আটটি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ আছে। পঞ্চম স্তূপটি থেকে আমরা আরও মনে করছি আটটি আছে। আটটি পেলে নাটেশ্বর যে বৌদ্ধধর্ম চর্চার একটি উন্নত শিখরে অবস্থান করছিল তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন বলেন, গত ১০ বছর ধরে আমরা খনন কাজ করছি। আমরা বৌদ্ধ মন্দির নগরী আবিষ্কার করেছি। এগুলো অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময় নির্মিত হয়েছে। এবারে সর্বশেষ আমরা একটি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ ধর্মচক্রসহ আবিষ্কার করেছি। এই ধরনের নিদর্শন বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। সেদিক থেকে এটা এক অবিস্মরণীয় আবিষ্কার। খনন কাজ অব্যাহত থাকবে আগামী দুই বছর। খনন কাজ শেষ হলে চীনাদের সহযোগিতায় এখানে যেন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো যেন সংরক্ষিত হয় সেজন্য আর্কিওলজিক্যাল পার্ক আমরা করবো। তখন সবার কাছে এটা শিক্ষণীয় ও দর্শনীয় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে। এমনকী আমি মনে করি, এটা বৌদ্ধদের কাছে দ্বিতীয় তীর্থক্ষেত্রে হিসেবে গড়ে উঠবে।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব মো. আবুল মনসুর বলেন, খনন কাজে নতুন আবিষ্কৃত স্থাপনা দেখে আমি খুশি। এর মূল্য অনেক। বাকি তিনটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর একটি ফরম্যাটে আসবে, একটি ম্যাপে আসবে। এর মাধ্যমে পর্যটন তথা আমাদের বিক্রমপুর যে প্রাচীন সভ্যতার অংশ তা সারাবিশ্বে প্রমাণিত হবে।
তিনি আরও বলেন, অতীশ দীপঙ্করকে বলা হয় বৌদ্ধ ধর্মের দ্বিতীয় পুরুষ। সরকারি প্রচেষ্টায় যদি এই স্থাপনা তার সময়ের তা প্রমাণ করা যায় তবে বিক্রমপুর পর্যটন তথা ধর্মীয় পর্যটনের জন্য গুরুত্ব বহন করবে।
২০১৩ সালে নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত হওয়া প্রত্ননিদর্শন সপ্তম থেকে ১২ শতকের বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মন্দির ও নগরের ধ্বংসাবশেষ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত নভেম্বরে নবম ধাপের খননকাজ শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণ।
আরাফাত রায়হান সাকিব/এমআরআর/জেআইএম