১৫ মাস ধরে বন্ধ পাবনা চিনিকল, ভোগান্তিতে আখ চাষিরা
আখ চাষি, চিনিকল শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষি ফেডারেশনের নানামুখী আন্দোলনের পরও গত ১৫ মাস ধরে বন্ধ পাবনা চিনিকল। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত মোতাবেক চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন পাবনা সুগার মিলসহ ছয়টি মিলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণা করে চিঠি দেয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় চিনিকলের ৭৮ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। পাবনা চিনিকল জোনে আখ চাষ তিন চতুর্থাংশ কমে গেছে। চিনিকল কর্তৃপক্ষ বলছে, আপাতত মাড়াই বন্ধ রাখা হয়েছে, মিলটি আবার চালু হতে পারে।
একসময় মিলটিকে ঘিরে ছিল ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য। শ্রমিক-কর্মচারী, চাষিদের কোলাহলে মুখর থাকতো পুরো কারখানা এলাকা। তবে এখন সে জায়গায় চোখে পড়ে সুনসান নীরবতা। মিল গেটের পাশে গড়ে ওঠা দোকানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে। যেখানে চায়ের কাপে প্রতিদিন ঝড় উঠতো সেসব চা-স্টলের চুলাগুলো এখন পরিত্যক্ত। আর এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোও ভিন্ন পেশা বেছে নিয়েছেন।
মিল গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গার্ড আর প্রশাসনিক কাজ চালু রাখতে এমডিসহ কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া কারও দেখা মিললো না। চিনিকলের ভেতরে খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছে আখ পরিবহনের দুই শতাধিক ট্রলি। মাড়াইয়ের যন্ত্রপাতিগুলোও মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে।
চিনিকল সূত্র জানায়, আখ মাড়াই প্ল্যান্টসহ চিনিকলে ৭৮ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় মাড়াই যন্ত্রের ডোঙ্গা, নাইফ, ক্রাসার, বয়লার হাউস, রুলার, ড্রায়ারসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় আখচাষি ও চিনিকল সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে ২৭ ডিসেম্বর পাবনা সুগার মিলটি ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে ৬০ একর জমির ওপর স্থাপিত হয়। এটি চালু করতে ১২৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। মিলটি ১৯৯৭-৯৮ মাড়াই মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়। পরের বছর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে মাড়াই মৌসুম চালু করে কারখানাটি। চিনিকল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জেলার ৯ উপজেলায় ব্যাপকভাবে আখ চাষ শুরু হয়। তবে উৎপাদন শুরুর পর থেকেই লোকসান গুনতে থাকে চিনিকলটি। ফলে ২০২০ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় চিনি আহরণের হার, আখের জমি, লোকসানের পরিমাণ এবং ব্যবস্থাপনার খরচ বিবেচনায় পাবনা চিনিকলসহ ছয়টি চিনিকলে আখমাড়াই না করার প্রস্তাব দেয়। এর পর থেকেই পাবনা চিনিকলে আখমাড়াই বন্ধ হয়ে যায়। এতে আখ নিয়ে ভোগান্তি শুরু হয় চাষিদের। বর্তমানে মিলটি প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দেনাগ্রস্ত। মিলটিতে স্থায়ী, অস্থায়ী ও মৌসুমিভিত্তিক শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ২০০। তাদের বিভিন্ন মিলে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
স্থানীয় কয়েকজন আখচাষি বলেন, বন্ধ ঘোষণার সময় চিনিকল কর্তৃপক্ষ তাদের উৎপাদিত আখ কাছের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল ও নাটোর চিনিকলে বিক্রি করতে পারবেন বলে জানায়। কিন্তু গত এক বছরেও সে প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়নি। ফলে আখ নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে চলতি মৌসুমে অনেক চাষি আখের জমিতে সবজি চাষ করেছেন। অন্যদিকে যারা আখ চাষ করেছেন, তারা আখ বিক্রি নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। আখ বিক্রি না হলে চাষিদের বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাবনা জেলা আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি আনছার আলী ডিলু জানান, জেলার ৯ উপজেলায় প্রায় ৩ হাজার ৩০০ জন আখচাষি রয়েছেন। চিনিকল চালু থাকা অবস্থায় তারা প্রায় ৬ হাজার একর জমিতে আখ চাষ করতেন। মিল বন্ধ ঘোষণার পর থেকে অনেকেই আখ চাষ বন্ধ করে দিয়েছেন। এরপর গত মৌসুমে প্রায় ১ হাজার ৫০০ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। কিন্তু এই আখ তারা কোথায় বিক্রি করবেন তা নিয়ে বেকায়দায় পড়েন।
তিনি জানান, ছয়টি চিনিকল বন্ধ ঠেকাতে পাঁচ দফা দাবিতে পাবনা সুগার মিলসহ ছয় চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও আখচাষি ফেডারেশন যৌথভাবে চিনিকল এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। তাদের আন্দোলন চলাকালে ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর মিল বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়।
আনছার আলী আরও জানান, চিনিকল চালু থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় ২৫ বিঘা জমিতে আখ চাষ করতেন। চিনিকলে আখ মাড়াই বন্ধ ঘোষণায় গতবছর ১৫ বিঘা জমিতে আখ চাষ করেছেন। আগামীতে হয়ত আরও কমে যাবে।
তিনি বলেন, ভালো ফলন ও সঠিক সময়ে আখ বিক্রি করতে পারলে প্রতি বিঘা জমিতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। কিন্তু সময়মতো বিক্রি করতে না পারলে আখ নষ্ট হয়ে যায়। তাই লোকসান ঠেকাতে দ্রুত আখ বিক্রি করার ব্যবস্থা থাকা দরকার।
পাবনার ঈশ্বরদীর আখ চাষি আমজাদ হোসেন বলেন, তারা বংশ পরম্পরায় আখ চাষ করে আসছেন। চিনিকল বন্ধ হওয়ায় সংকটে পড়েছেন।
তিনি বলেন, আখ চাষকে ভালবাসেন বলেই বছরের পর বছর টাকা বাকি থাকা সত্ত্বেও এক যুগ ধরে আখ চাষিরা তাদের আখ পাবনা সুগার মিলে সরবরাহ করে এসেছেন। তারা অন্য ফসল বাদ দিয়ে আখ চাষ বাড়িয়ে চলেছেন। হঠাৎ করে পাবনা চিনিকল বন্ধ হওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ চিনিকল আখ চাষি ফেডারেশনের মহাসচিব এবং পাবনা জেলা আখ চাষি কল্যাণ সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী বলেন, কৃষকদের স্বার্থে দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখের উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য বন্ধ মিল চালু করা দরকার। এসব মিলের সঙ্গে জড়িত কৃষকরা দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল আখ চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। ফলে, দেশীয় চিনি উৎপাদন বড় ধরনের সংকটে পড়বে। চিনির বাজার পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে বাইরে চলে যাবে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
শাহজাহান আলী জানান, দেশে বিমান, রেলওয়ে, তাঁত শিল্প তো লোকসানে আছে। সেগুলো তো বন্ধ হচ্ছে না। ওই সব সেক্টরের তুলনায় সামান্যই লোকসান চিনিকলে। তারপরও মোট চিনিকলের স্থাবর সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। সে টাকার বার্ষিক ৪ শতাংশ মুনাফা ধরলেও বছরে বাড়ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সে হিসেবে চিনিকলকে অলাভজনক বলা যাবে না। পাবনাসহ দেশের ছয়টি মিল বন্ধ করে দেওয়া হলো। এতে পাবনার আখ চাষিরা চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
তিনি বলেন, দেশে চিনিকল চালু আছে তাই আজও চিনির বাজার সহনশীল। সব চিনিকল বন্ধ ঘোষণার পরদিন থেকেই চিনির দাম চারগুণ বেড়ে যাবে।
পাবনা জেলা আখ চাষি কল্যাণ সমিতির এই নেতা আরও বলেন, পাবনা চিনিকল আবার চালু করতে কৃষক-শ্রমিক- কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে রয়েছেন। করোনার কারণে তাদের আন্দোলন ব্যাহত হয়েছে। তবে তারা তাদের পাঁচ দফা দাবিতে অটল বলে জানান। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বাংলাদেশের সব চিনিকলে আখ মাড়াই করতে হবে। বকেয়া বেতনসহ শ্রমিক-কর্মচারী ও চাষিদের সব পাওনা পরিশোধ করতে হবে, কৃষক পর্যায়ে সার-কীটনাশকসহ সব উপকরণ সরবরাহ করতে হবে।
পাবনা চিনিকলের সাবেক বেশ কিছু কর্মচারী জানান, তাদের দেশের বিভিন্ন চিনিকলে সংযুক্ত করা হচ্ছে। এতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। অনেকে সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদল করতেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
এ বিষয়ে পাবনা চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফ উদ্দিন বলেন, চিনিকলটি এখনো পুরোপুরি বন্ধ করা হয়নি। আধুনিকায়নের মাধ্যমে এটি চালুর প্রক্রিয়া চলছে। তবে যতদিন পর্যন্ত চালু না হচ্ছে তত দিন পাবনা জেলার আখচাষিদের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। ফলে জমির আখ নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তার কিছু নেই।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে পাবনা চিনিকলের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। আর মিলটিতে কর্মরতদের অন্য চিনিকলে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
এমআরআর/জেআইএম
টাইমলাইন
- ১০:১৪ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ চিনিকল না থাকায় সাতক্ষীরার আখে তৈরি হচ্ছে গুড়
- ০৯:৪৮ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ ৫১৪ কোটি টাকা লোকসানে রংপুর সুগার মিল
- ০৯:৪৩ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ আখের দাম বাড়িয়ে মিল চালুর চিন্তা করছে করপোরেশন-মন্ত্রণালয়
- ০৯:২৫ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ নওগাঁয় প্রতি বছর কমছে আখ চাষ
- ০৯:১৩ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ ১৫ মাস ধরে বন্ধ পাবনা চিনিকল, ভোগান্তিতে আখ চাষিরা
- ০৮:৫৭ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ কত?
- ০৭:৫৯ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ চাহিদা থাকলেও বাজারে নেই আখের চিনি!
- ০৭:২০ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ ৫ বছরে ১ কোটি সাড়ে ১১ লাখ টন অপরিশোধিত চিনি আমদানি
- ০৬:৪৯ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জয়পুরহাট সুগারমিল
- ০৫:৫৯ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় সাদা চিনি’
- ০৫:৩৪ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ বন্ধ চিনিকলেও বাড়ছে দেনা
- ০৪:১৬ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ লোকসান কমাতে আরও দুই চিনিকলে মদ তৈরির উদ্যোগ
- ০৪:০৯ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ বহুমুখী সংকটে মোবারকগঞ্জ চিনিকল
- ০২:৪৫ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানোর সুবিধা পাচ্ছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা
- ০১:৪৮ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ ঋণের বোঝায় খুঁড়িয়ে চলছে জিল বাংলা সুগার মিল
- ১২:৩৩ পিএম, ৩১ মার্চ ২০২২ চিনিতে বাড়ছে আমদানিনির্ভরতা, বছরে ব্যয় ৭ হাজার কোটি
- ১১:০৯ এএম, ৩১ মার্চ ২০২২ বন্ধের খবরে কমেছে চাষ, আখ সংকটে রাজশাহী চিনিকল
- ১০:৫৩ এএম, ৩১ মার্চ ২০২২ পাঁচ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের লোকসান ৪৩৫১ কোটি টাকা
- ১০:২৫ এএম, ৩১ মার্চ ২০২২ লোকসানে ডুবতে বসেছে ফরিদপুর চিনিকল
- ০৯:৪৬ এএম, ৩১ মার্চ ২০২২ পুকুর-জমি লিজ দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন কুষ্টিয়া চিনিকলের কর্তারা
- ০৯:৫১ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২ পঞ্চগড় চিনিকল বন্ধ, আখের জমিতে টমেটো-ভুট্টা চাষ
- ০৯:০২ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২ ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে সরকারি চিনিকলের উৎপাদন
- ০৮:৩২ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২ ৮৪ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন উৎপাদন কেরু চিনিকলে
- ০৭:১৭ পিএম, ৩০ মার্চ ২০২২ মিল এলাকায় আখ চাষে ভাটা, অন্য ফসলে বাড়ছে আগ্রহ