বগুড়ার শিয়া মসজিদে হামলার রহস্য উদঘাটন
ইসলামকে বিকৃত রূপ দেয়া, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) কে নবী না মানার অপরাধে অভিযুক্ত করে প্রতিশোধ স্বরূপ বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত শিয়াদের মসজিদে সশস্ত্র বন্দুক হামলা চালানো হয়েছিল।
নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন অব বাংলাদেশ (জেএমবি) এর সুইসাইডাল স্কোয়াড ইসাবার (কতল গ্রুপ) ৩ জন প্রশিক্ষিত ক্যাডার এই হামলায় অংশ নেয়। আর হামলার আগে ঘটনাস্থল রেকি করাসহ আশপাশের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে জেএমবির দায়ী (দাওয়াতি) গ্রুপের আরও ২ জন সদস্য। আর এই হামলার নির্দেশনা থেকে শুরু করে সেটির পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিল মোট ৭ জন। এর মধ্যে হামলার ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে বগুড়া পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পরিকল্পনা বৈঠকে অংশ নেয়া জেএমবি সদস্য ইয়াসিন আলী সম্প্রতি আদালতে হামলার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবান্দিও দিয়েছে।
২৬ নভেম্বর মাগরিবের নামাজের সময় শিবগঞ্জ উপজেলার চককানুপুর গ্রামে শিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদ-ই-আল মোস্তফায় সশস্ত্র বন্দুক হামলা চালানো হয়। এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত এবং আরও ৪ জন আহত হয়। ওই হামলায় ইয়াছিন, এমদাদুল হক ও আব্দুল বাছেদসহ মোট ৫ জন জড়িত ছিল। আর তাদের নির্দেশদাতা হলেন দিনাজপুরে অবস্থানকারী জেএমবির শীর্ষ এক নেতা। গ্রেফতার হওয়া ইয়াসিন ও বাসেদ জেএমবির দায়ী (দাওয়াতি) গ্রুপের সদস্য। এরা মূলত নতুন সদস্য সংগ্রহ এবং ছদ্মবেশে হামলার স্থান রেকি করে। আর এমদাদুল হলো জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াড ইসাবার (কতল) সদস্য। এই গ্রুপের কাজ শুধু টার্গেটের উপর হামলা চালানো।
বগুড়ার পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, জেএমবি এই হামলার সঙ্গে জড়িত সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একই সঙ্গে সমগ্র উত্তরাঞ্চল জুড়ে তাদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য মিলেছে। ইতোমধ্যেই পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এই দলের ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। যাদের মধ্যে ৩ জন সরাসরি জড়িত।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শিয়া মসজিদে হামলার আগে বগুড়া শহরতলীর পালশা এলাকা থেকে গ্রেফতার হয়েছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের একটি গ্রুপ। পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের দেয়া সূত্র ধরেই পুলিশ মসজিদে হামলা মামলার কিলার গ্রুপদের শনাক্ত ও রহস্য উন্মোচনে এগিয়ে যায়। এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে সাতজনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আর তিনজন শিয়া মসজিদে হামলার ঘটনায় জড়িত। অন্যরা জেএমবির বিভিন্ন পর্যায়ের ক্যাডার।
সূত্র জানায়, জেএমবির ‘দায়ী’ ও ‘ইসাবা’ টিমের সমন্বয়ে শিয়া মসজিদে হামলা করা হয়। ‘দায়ী’ গ্রুপের দায়িত্ব থাকে সদস্য, অর্থ সংগ্রহ ও পরিকল্পনা করা এবং ইসাবা গ্রুপের কাজ কিলিং (কতল) মিশন। গত ২৩ নভেম্বর শিবগঞ্জের আটমূলের একটি বাড়িতে বসে শিয়া মসজিদে হামলার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা বৈঠকে ছিলো ইয়াসিন আলী, এমদাদুল হক, আব্দুল বাছেদসহ আরও ২ জন। আর ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় কিলিং মিশনে অংশ নেয় মোট ৩ জন। তাদের মধ্যে জেএমবির সুইসাইডাল কতল গ্রুপের সদস্য এমদাদুলও রয়েছে। হামলাকারী বাকি ২ জনকে এখনো গ্রেফতার করা সম্ভব না হলেও পুলিশ বলছে সবকিছু হাতের নাগালে। শিগগিরই পুরো টিম গ্রেফতার হবে।
গ্রেফতার হওয়া ইয়াসিন আলী নিজেকে দায়ী গ্রুপের সদস্য দাবি করে পুলিশকে জানায়, তার কাজ ছিলো মূলত তথ্য সংগ্রহ করা। তথ্য সংগ্রহ করার পর কতল গ্রুপ অ্যাকশনে নামে। তারা কখন, কিভাবে, কোন অস্ত্র ব্যবহার করে হামলা চালাবে সেটি দায়ী গ্রুপ জানে না। এক ভাবে নিজেদের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরতে দায়ী গ্রুপের সদস্যরা দাড়ি রাখে এবং কতল গ্রুপের সদস্যরা হয় ক্লিন সেভ। তারা আধুনিক পোশাক পড়ে মানুষের মাঝে মিশে থাকে।
পরিকল্পনাকারী হিসেবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে জেএমবি ক্যাডার ইয়াসিন। গত ১২ ডিসেম্বর বগুড়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম ফেরদৌস ওয়াহিদের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক এই জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। তবে জবানবন্দির বিষয়টি পুলিশ প্রকাশ করেনি।
পুলিশ বলছে, ইয়াসিন আলী নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির বগুড়া অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তবে মূল পরিকল্পনাকারী দিনাজপুরের একজন শীর্ষ নেতা। ইয়াসিনের বাড়ি জয়পুরহাট সদর থানার সোড়াহার গ্রামে। তাকে ১০ ডিসেম্বর জয়পুরহাট থেকে গ্রেফতার করা হয়। আর এমদাদুল হক ও আব্দুল বাছেদের বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার আটমুল পশ্চিমপাড়ায়। তাদেরকেও নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে এমদাদুল ও বাছেদ বগুড়া কারাগারে থাকলেও ২২ ডিসেম্বর অধিকতর জিজ্ঞসাবাদের জন্য ইয়াসিনকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, আদালতে জবানবন্দিতে ইয়াসিন বলেছেন, ধর্মীয় মতাদর্শগত পার্থক্যের কারণে জেএমবির পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক শিয়া মসজিদের হামলা চালানো হয়েছে। দেশের আহমদিয়া ও শিয়াদের মসজিদসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের হামলার টার্গেটের মধ্যে রয়েছে। কারণ এরা ৩ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে এবং আদায়ের নিয়মও ভিন্ন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) কে রাসুল না মেনে আলীকে রাসুল মানে। ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো কাফেরি কাজ। এ কারণে এরা টার্গেট হয়েছে। একইভাবে ভণ্ড পীর ও মাজার শরীফগুলোকেও টার্গেট করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শিয়া মসজিদে হামলার মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বগুড়ায় জেএমবিসহ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাংগঠনিক অবস্থা, কার্য প্রণালীসহ তাদের ভয়ানক পরিকল্পনার বিষয় জানতে পারে। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলে আরও একাধিক জেলায় সহিংসতা ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু বগুড়া পুলিশ প্রশাসন দ্রুত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ায় জঙ্গিদের সেইসব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। আর সমগ্র উত্তরাঞ্চল জুড়ে জেএমবির নেটওয়ার্কের কথা বলা হলেও মূলত তাদের দায়ী ও কতল গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট ও নীলফামারী জেলায়।
গ্রেফতার হওয়া জেএমবির দায়ী গ্রুপের সদস্যরা জানায়, বগুড়ায় তাদের দলের সক্রিয় সদস্য রয়েছে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন। এদের ১৫ থেকে ২০ জনের নাম পুলিশের গ্রেফতার তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে আবার ইসাবা টিমের সদস্য রয়েছে অন্তত ৪/৫ জন। জেএমবির এক পর্যায়ের ক্যাডারদের সঙ্গে অন্য পর্যায়ের ক্যাডারদের সংযোগ থাকে না। আধুনিক প্রযুক্তি বিষয়ে এরা অভিজ্ঞ। শিয়া মসজিদে হামলার আগে ও পরে জেএমবির দায়ী ও ইসাবা গ্রুপের সদস্যরা চতুরতার পাশাপাশি সতর্কতার আশ্রয় নেয়। হামলার সময় তারা ওই এলাকায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেনি এবং মোবাইল ফোন তাদের সঙ্গেও ছিল না। এ কারণে তাদের শনাক্ত করতে তদন্তকারীদের বেশ বেগ পেতে হয়। দলের ইসাবা গ্রুপের সদস্যদের বিশেষ কমান্ড ট্রেনিং দেয়া হয়। হামলার স্থান থেকে প্রাণ নিয়ে না ফিরতে পারলে তা নিজেরাই সুইসাইড করবে এমন নির্দেশনা থাকে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপগুলো শুধু নাম পাল্টায়। কিন্তু তাদের মূল একই বলে আমার কাছে মনে হয়। কারণ তাদের সবার ধরন এবং কর্মপদ্ধতি একই রকম। এর আগে বগুড়াতে জেএমবি নাম পাল্টিয়ে বিএমই নামে আত্মপ্রকাশের চেষ্টা করেছিল। আর ২০১৩ সালে মিরপুর ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যার ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে আটকের পর আলোচনায় আসে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। তখন জানা যায়, জসীমুদ্দিন রাহমানী এ সংগঠনের আধ্যাত্মিক নেতা। পরে বরগুনা থেকে বেশ কয়েকজন অনুসারীসহ জসীমুদ্দিন রাহমানী আটক হন। তিনি এখনও কারাগারে থাকলেও তার অনুসারীরা বাইরে আছেন। তাদের মধ্যে একজন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ`র সাবেক ছাত্র রেদওয়ান আজাদ রানা পলাতক অবস্থায় সংগঠনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যেই তারা বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলায় তাদের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করেছে।
এছাড়া ঢাকার মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের এক শিক্ষককে হত্যার চেষ্টা, মোহাম্মদপুরে রাকিব মামুন নামে এক ব্লগারকে গুলি ও আশুলিয়ায় আরেক ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছিল। ওই সময়ের পর ‘আনসার আল শরিয়াহ` ও ‘আনসার আল ইসলাম` নামে দুটি সংগঠন দায় স্বীকার করে। সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যার পর পরই টুইটার বার্তায় দায় স্বীকার করেছিল আনসার বাংলা-৮ নামে একটি সংগঠন। কিন্তু সব সংগঠনই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে প্রচারণা চালাচ্ছে বলে তারা নিশ্চিত হয়েছে।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, জেএমবিসহ অন্যান্য নিষিদ্ধ জঙ্গি দলগুলো আল কায়েদার ‘লোন উলফ, এবং ‘স্পিপার সেল পদ্ধতিতে হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ফলে নেপথ্যে কারা আছে তা সব সময় জানা যায় না। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন তারাও খুব বেশি উপরের লোকজনকে চেনে না বা জানেন না। আর তাদের কেউ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বা বোমা বিশেষজ্ঞ। আবার কেউ হত্যাকাণ্ডে পারদর্শী। তারা যেসব অস্ত্র ব্যবহার করে সেগুলোও অত্যাধুনিক।
বগুড়ার শিয়া মসজিদের হামলার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ঘটনায় অত্যাধুনিক অটোমেটিক পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে। আর এই ঘটনাতেও মূল নির্দেশদাতাকে কতল গ্রুপের সদস্যরা চেনে না বা নাম বলতে পারে না।
শিয়া মসজিদে হামলা মামলার তদন্ত কাজে সহায়ক কমিটির প্রধান বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মন্ডল বলেন, শিয়া মসজিদে হামলাকারীরা চিহ্নিত হয়েছে। কিলিং মিশনে ছিল জেএমবির ইসাবা টিম এটিও নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন বাকিদের ধরা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
উল্লেখ্য, গত ২৬ নভেম্বর শিয়া মসজিদে বন্দুকধারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৮) মারা যান। মসজিদের ইমামসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় ওই রাতেই শিবগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা হয়।
লিমন বাসার/এসএস/পিআর