উপার্জনের সবই যায় সমাজসেবায়
‘২০১৩ সালের ১৭ই মার্চ থেকে রক্তদান, নাইটস্কুল পরিচালনা, মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনা, আর্থিক অনুদান, করোনাকালে অর্থ-খাবার বিতরণ ও শীতে বস্ত্র বিতরণ করে যাচ্ছি। এসব করি নিজের উপার্জনের অর্থে। এতে উপার্জনের একটা টাকাও পকেটে থাকে না, সবই যায় সমাজসেবায়।’ কথাগুলো বলছিলেন সমাজসেবক মোহন আলী।
মোহন আলী পেশায় বাংলাদেশ আনসার ভিডিপির সদস্য। ২০১৬ সাল থেকে নগরীর ১৮নং ওয়ার্ড দলনেতা হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এছাড়াও বারিন্দ মেডিকেল কলেজে কর্মরত রয়েছেন ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে।
নগরীর শাহমুখদুম থানার পবা নতুন পাড়ায় বসবাস তার। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা আব্দুল হামিদ কর্মজীবী মানুষ। তিনি মারা যান ২০১৫ সালে। ২০১০ সালের দিক থেকে ডায়াবেটিস ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। বাবা অসুস্থ থাকা অবস্থাই মোহন অসহায় ও গরিব মানুষের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করেন। তাই নিজের উপার্জনের সর্বস্ব লুটিয়ে দেন সমাজসেবায়।
শিক্ষাজীবনেই তিনি রক্তের যোগানদাতা হিসেবে রাজশাহীতে পেয়েছেন সুপরিচিতি। এ পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে করেছেন রক্তদান। রক্তের প্রয়োজন হলেই রাজশাহীতে উচ্চারিত হয় মোহনের নাম। সেই চিন্তা থেকেই গড়ে তোলেন সার্বজনীন স্বেচ্ছায় রক্তদান সংস্থা। এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি অসহায়-গরিবদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ-চিকিৎসা সেবাদান, আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।
আনসার মোহন আলী বলেন, আনসারের চাকরি ও ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে দু’জায়গায় যা উপার্জন করি তার প্রায় সবটাই খরচ হয়ে যায়। এমন অনেক দিন গেছে রক্তদান, শীতবস্ত্র বিতরণ কিংবা অসহায় কোনো ব্যক্তির বাড়ির খাবার কেনার জন্য অন্যের কাছে ঋণও করতে হয়েছে। নিজের উপার্জনের অর্থ বাড়ির মানুষগুলোকে দিতে ব্যর্থ হই। আমার এ কাণ্ডে মা, ভাই-বোনেরা মন খারাপ করলেও মুখ ফুটে কোনোদিন কিছু বলেন না।
মোহন আলী জানান, রামেক ব্লাড ব্যাংক, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, বাঁধনসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন বিপদের মুহূর্তে তাকে ফোন করেন। রক্তের প্রয়োজনে প্রায় ৩০ থেকে ৫০টি পর্যন্ত ফোন আসে দিনে। প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৪ থেকে ৫ ব্যাগ রক্ত জোগাড় করে দেন তিনি।
মোহন আলী তার ‘সার্বজনীন স্বেচ্ছায় রক্তদান ফাউন্ডেশন’ বিষয়ে বলেন, সংগঠনটি ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের উদ্দেশ্য বিপদের সময় রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচানো। নিজ খরচে হাসপাতালে গিয়ে ডোনারকে নিয়ে রক্তদান করা হয়। সংগঠনের কেউ রক্তদান করলে তাকে ডাবের পানি ও ডিম খাওয়ানোর টাকাটাও আমিই দেই। কেউ অর্থ দিলেও তা গ্রহণ করি না।
মোহনের নেওয়া এসব মহৎ উদ্যোগে এগিয়ে এসেছেন শাহমুখদুম এলাকার বেশকিছু যুবক। এর মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সহ-সম্পাদক ফারুক আলম পাপ্পু। তিনি ফাউন্ডেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও রয়েছেন।
তিনি জানান, ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন অর্থ ব্যয় হয়। এ অর্থের বেশিরভাগই দেন মোহন আলী। তিনি খুব ছোটখাট দুটা চাকরি করেন। কিন্তু নিজের উপার্জন ফাউন্ডেশনের কাজেই ব্যয় করে দেন। শুধু তাই নয়, নিজে জুন মাসের শেষের দিকে করোনা আক্রান্ত হন। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টেও ভুগতে হয় তাকে। তারপরও মানুষ তাকে ফোন দিয়েছে, রক্ত পেয়েছে। আমরা তার দ্বারাই সমাজসেবার এ কাজে অনুপ্রাণিত।
শাহমুখদুমের বাসিন্দা আদরী বেগম বলেন, আমার স্বামী নেই। ছোট একটি দোকান দিয়ে চলে সংসার। অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। কিন্তু আমাদের এলাকার ছোটভাই মোহন এলাকায় ডাক্তার এনে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এতে অনেক সুবিধায় হয়েছে।
আরেক স্থানীয় বৃদ্ধা সারভানু বেগম। চোখে ছানিজনিত কারণে ঝাপসা দেখতেন তিনি। মোহনের ফ্রি চক্ষু চিকিৎসার ব্যবস্থায় তিনি ছানি অপারেশনসহ পেয়েছেন বিনামূল্যে ওষুধ। এনিয়ে মোহনকে অনেক দোয়াও করেন তিনি।
এদিকে শিক্ষার আলো পাওয়া রাসিক পরিচ্ছন্ন কর্মী শ্রীমান ভূইঞা বলেন, আগে পড়তে পারতাম না। এখন সাইনবোর্ড বা যেকোনো লেখা পড়তে পারি। হিসাব-নিকেশ করতে পারি। স্বাক্ষরও পারি। তাই আরও পড়তে চাই।
মোহনের নাইটস্কুলের আরেক শিক্ষার্থী টনি। পেশায় কাপড়ের প্রিন্টার। একবার ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু সাইনবোর্ড পড়তে পারায় আবার বাড়ি ফিরতে সক্ষম হয়।
মোহন আলী জানান, স্বাক্ষরতা দানের ক্ষেত্রে প্রথম দফায় ৩২ জন নিরক্ষরকে লেখাপড়ার যাবতীয় উপকরণসহ এককভাবে শিক্ষা দিয়েছিলাম। যাদের মধ্যে ২৪ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ৮ জন বাঙালি। এখন তারা তাদের স্বাক্ষরসহ সবকিছু লিখতে ও পড়তে পারেন। এভাবে আরও ২৬ জনকে দ্বিতীয় দফায় স্বাক্ষরতা প্রদান করা হয়।
নিরক্ষর বয়স্ক ব্যক্তিরা যেন কোনোভাবে সমাজে কারো দ্বারা প্রতারণার স্বীকার না হন এবং কারো কাছে ‘অশিক্ষিত’ বলে লাঞ্ছিত না হন সে কারণে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত করা। তারা যেন সমাজের আর দশজনের মতো আত্মসচেতন হয়ে উঠে এটায় কাম্য বলেন তিনি জানান। তবে স্বাক্ষরতার মিশনটি থেমে যায় করোনার কারণে।
তিনি বলেন, প্রায় একহাজার মানুষের চোখের ফ্রি চিকিৎসা করানো হয়েছে। যার ডোনার ছিলো ঢাকা লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল এবং সার্বিক সহযোগিতায় বারিন্দ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ ক্যাম্পেইনে ছানি অপারেশন, লেন্স লাগানো ও অন্যান্য রোগ নির্ণয়সহ ফ্রি ওষুধ বিতরণ করা হয়েছে। প্রায় ২২০০ মানুষকে কীটের মাধ্যমে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়েছে। এপর্যন্ত ১৩০০ জনের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করা হয়েছে।
যখন কেউ করোনায় মৃতদের দাফন করতে চাইছিলো না, তখন আনসার বাহিনী ও প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে প্রায় ২০ জন করোনায় মৃত ব্যক্তিকে দাফন করেছি আমরা।
এছাড়াও শাহমুখদুম এলাকায় গতবছর শীতে বিদেশ থেকে আসা ২ বেল্ট শীতের কাপড় কিনে প্রায় ৪০০ জনের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। এমনকি যারা লোকলজ্জায় সামনে আসতে পারেননি, তাদেরকে গোপনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরম কাপড় দেওয়া হয়েছে বলেও জানান এ সমাজসেবক।
তার এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে এখনো অনুমতি নেয়নি। এখন পর্যন্ত নিজের উপার্জনের অর্থ ও কিছু সংখ্যক দাতাদের সাহায্যে চলছে সংগঠনটি। সংগঠনটি সমাজসেবা অধিদপ্তরে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে সমাজের সকল মানুষের মাঝে হাসি ফোটাতে চান বলে জানান তিনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোছা. হাসিনা মমতাজ বলেন, এমন মানুষকেই সমাজসেবা অধিদপ্তর চায়। তার যদি সংগঠন থেকে থাকে তবে অবশ্যই রেজিস্ট্রেশনভুক্ত করা উচিৎ। এতে আমরা তাকে বাৎসরিক একটা অনুদান দিতে পারবো। যে অর্থ তিনি তার সমাজসেবায় ব্যয় করতে পারবেন। ফলে তার ব্যক্তিগত অর্থ খরচের প্রয়োজন পড়বে না বলে মন্তব্য করে তিনি।
এফএ/জেআইএম