ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

অসহায়দের জন্য মন কাঁদে মাহবুবের

আমিন ইসলাম জুয়েল | প্রকাশিত: ০৭:১৪ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২২

দরিদ্র মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, অসহায়দের অন্ন-বস্ত্রদান, শীতার্ত মানুষের পাশে থাকা, নলকূপের ব্যবস্থা করা, রমজানে শহরের ভাসমান মানুষদের জন্য সাহরির ব্যবস্থাসহ নিভৃতে মানবসেবা করে যাচ্ছেন পাবনা শহরের বাসিন্দা দেওয়ান মাহবুব (৪০)। করোনাকালেও সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে কাঁধে অক্সিজেন সিলিন্ডার বেঁধে দিনরাত ছুটেছেন রোগীর বাড়িতে।

কোরবানির ঈদে অসহায়দের প্লেটে কিছু মাংস তুলে দেওয়ার জন্য বিশেষ কোরবানির ব্যবস্থা করেছেন। নিজ সামর্থ্যে যখন কুলিয়ে উঠতে পারেন না তখনই বিত্তবানদের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করেন।

দেওয়ান মাহবুব পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের দর্শন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দেওয়ান আজিজুল ইসলামের ছেলে ও পাবনা শহরের কালাচাঁদপাড়ার বাসিন্দা।

দেওয়ান মাহবুবের মা জান্নাতুন তহুরা ২০০২ সালে মারা যান। সে বছরই তিনি তার বাবা-মায়ের নামানুসারে প্রতিষ্ঠা করেন তহুরা-আজিজ ফাউন্ডেশন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরিদ্র রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা এবং ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন।

jagonews24

ওষুধ কোম্পানির একটি ভালো পদে চাকরি করতেন দেওয়ান মাহবুব। চাকরি করার সময় তার উপলব্ধি হয়, হাসপাতালে প্রেসক্রিপশন পেলেও অনেক রোগীর ওষুধ কেনার সামর্থ্য থাকে না। তখন থেকে তিনি মনস্থির করেন রোগীদের চিকিৎসাসহ ফ্রি ওষুধ দেওয়া হবে। এরপর থেকে বাবা-মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান থেকে গত এক যুগে প্রায় দেড় লাখ লোকের ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

কোনো খরচ ছাড়াই সপ্তাহে তিনদিন সেবা দেওয়া হয় তহুরা-আজিজ ফাউন্ডেশন থেকে। প্রতি শুক্রবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা এবং রবি ও মঙ্গলবার দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেবা দেওয়া হয়। জেলার সব উপজেলার মানুষই আসেন এখানে।

এক যুগের ব্যবধানে নিজের মানবসেবা কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করেছেন মাহবুব। অসহায়দের বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণের পাশাপাশি দুস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করা, সেলাই মেশিন ও ছাগল বিতরণ, মাছচাষে সহযোগিতা, বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টিউবওয়েল প্রদান অব্যাহত রয়েছে।

jagonews24

পাবনার সুইপার কলোনিতেও অবহেলিত মানুষের জন্য নলকূপের ব্যবস্থা করেছেন দেওয়ান মাহবুব। এছাড়া শহরের বিভিন্ন রাস্তার পাশে নলকূপ স্থাপন করেছেন। তার মানবিক এ কার্যক্রম দেখে পাবনার অনেক দানশীল ব্যক্তি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

সন্তানদের অবেহলার শিকার বিধবা মা, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারী, যৌনকর্মী, হরিজন, বিকলাঙ্গ, ফকির-মিসকিনদের থাকার কোনো জায়গা নেই। তাদের জন্য নিজের প্রতিষ্ঠানকে আস্থার ঠিকানা করতে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২০ সালের ২২ মে করোনা উপসর্গে মারা যান পাবনা সদর উপজেলার নুরুজ্জামান নুরু খান। তার বাড়ি পাবনা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পাবনা সদর উপজেলার গয়েশপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধোপাঘাটা গ্রামে। করোনা উপসর্গে মারা যাওয়ার পর তার গোসল, জানাজা ও দাফন হচ্ছিল না। মরদেহ বিছানায় পড়ে ছিল কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা। বাড়ির আশপাশে শ শ লোক জড়ো হলেও তারা বাড়ির ভেতরে আসেননি। প্রশাসনের লোকজন অনুরোধ করলেও সেদিন গ্রামের কেউ তার কাছে যাননি। খবর পেয়ে পানি গরম করে গোসল করিয়েছিলেন দেওয়ান মাহবুব।

jagonews24

২০২০ সালের ৯ জুন ভোরে করোনা উপসর্গে মারা যান পাবনার সুজানগরের ইদ্রিস আলী মিয়া (৬০)। করোনা সংক্রমণের ভয়ে ওই বাড়ির লোকজন, প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন কেউই তার গোসল করাতে এগিয়ে আসেননি। খবর পেয়ে তার দাফনের ব্যবস্থা করেন পাবনার এ যুবক।

শুধু দাফনকাজই নয়, প্রায় ২০০ করোনা রোগীকে ফ্রি অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়েছেন তিনি। কখনও নিজে কাঁধে করে রোগীর বাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দিয়েছেন।

গত বছর কয়েকজন নারীকে ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়েছেন মাহবুব। বিভিন্ন মসজিদ, গোরস্তান ও হাটবাজারে ১০টি টিউবওয়েল স্থাপন করে দিয়েছেন। সেলাই মেশিন দিয়েছেন দুই নারীকে। গত বছর একজন দরিদ্রকে মাছচাষে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের বাড়ির পাশে পুকুর সংস্কার করে সেখানে মাছের পোনা দিয়েছেন। দুজনকে ভ্যান কিনে দিয়েছেন। অন্তত দুই হাজার পরিবারকে দিয়েছেন একটি করে গাছের চারা।

করোনা মহামারির শুরুতেই অন্তত দুই হাজার পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন। ১০০ পরিবারকে সবজি, ১০০ পরিবারকে ডিম ও ৫০০ কিশোরীর মাঝে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ করেছেন।

jagonews24

দেওয়ান মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে ঈদুল আজহায় অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার কোরবানি দিতে পারেনি। তারা কিন্তু কারও কাছে কোরবানির মাংস চাইতেও পারেন না। তাই আমরা সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম সাত হাজার টাকার একভাগ অথবা ৫০ হাজার টাকা মূল্যে একটি গরু কোরবানি দেওয়ার অর্থ আমার কাছে দিতে। আমরা সে উদ্যোগে সফল হয়েছিলাম। গোপনীয়তা বজায় রেখে অনেকের বাড়ি মাংস পৌঁছে দেওয়া হয়।’

রমজানে সাহরি-ইফতার বিতরণে ব্যস্ত থেকেছেন মাহবুব। তিনি তার টিমসহ সাহরির শেষ সময়ের বেশ আগেই বের হতেন। কারণ খাবার প্যাকেট পৌঁছে দিতেও বেশ সময় লাগে। তিনি জানান, প্রতিদিন তার সহযোগীদের সঙ্গে করে খাবার রান্না করেছেন। পরে প্যাকেট করে (২০০-৩০০ প্যাকেট, বাজেট সাপেক্ষে) বিতরণ করেছেন দুস্থ, অসহায় ও শ্রমজীবীদের মাঝে।

পাবনা সদরের শিবরামপুর মহল্লার আফজাল হোসেনের স্ত্রী লাকী খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, স্বামীর একার আয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। তাই মাহবুব ভাইয়ের কাছে বলার পর গত রোজার মধ্যে তিনি একটি সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছেন। তা দিয়ে কাজ শুরু করেছি।

সদর উপজেলার বলরামপুর গ্রামের ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘ভ্যানে করে সবজি নিয়ে পাড়া-মহল্লায় বিক্রি করে সংসার চালাই। সম্প্রতি ভ্যানটি নষ্ট হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে মাহবুব একটি ভ্যান কিনে দিয়েছেন।’

jagonews24

দেওয়ান মাহবুব বলেন, শুধু আর্থিক সহায়তা দিয়ে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী করার একটা পরিকল্পনা নিয়েছেন। তিনি ‘হাংরি পাবনা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ করেছেন। এ গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ৫১ হাজার। ওই গ্রুপের মাধ্যমে নারীদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করছেন।

সুজানগর পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল ওয়াহাব জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনায় দাফন-কাফনের সময় দেওয়ান মাহবুবের মহত্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছি।’

সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও পাবনা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মাহাতাব উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, ‘পাবনা শহরের দেওয়ান মাহবুব একজন আলোকিত মানুষ। তিনি নীরবে-নিভৃতে সমাজ সংস্কারকের কাজ করে যাচ্ছেন। তার ভালো ভালো কাজ দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি নিজেও তার বিভিন্ন কল্যাণকর কাজে শরিক হয়েছি।’

মাহবুব জানান, মানবিকতার জায়গা থেকেই তিনি এমন কাজে ব্রতী হয়েছেন। তিনি বলেন, মানবসেবায় নিজেকে জড়িয়ে রাখার মাধ্যমে যে আত্মিক প্রশান্তি পাওয়া যায় তা আর অন্য কোনো উপায়ে পাওয়া সম্ভব নয়।

আমিন ইসলাম জুয়েল/এসআর/এএসএম