আবাসন দূরের কথা, সরকারি কার্যালয়ই চলছে ভাড়া বাসায়
দেশের আটটি প্রশাসনিক বিভাগের একটি বরিশাল বিভাগ। ১৯৯৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি জেলা নিয়ে এই বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। বিভাগ হওয়ার কারণে বরিশাল নগরীতে সরকারি অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার বিভাগীয় কার্যালয় চালু হয়েছে। বেড়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা। তবে বিভাগ প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পরও বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সরকারি আবাসনের ব্যবস্থা হয়নি।
এমনকি নিজস্ব স্থাপনা না থাকায় ভাড়া বাসায় চলছে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দাপ্তরিক কার্যক্রম। নিজস্ব স্থাপনা ও আবাসন-সংকটের কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিশেষ করে প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের এ সমস্যা প্রকট।
সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ১০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল নগরীতে ভাড়া বাসায় চলছে মেট্রোপলিটন পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, পরিসংখ্যান অফিস, বিভাগীয় তথ্য অফিস, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরসহ অন্তত সরকারি ২০টি বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, বরিশাল নগরীতে অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার জেলা কার্যালয় রয়েছে প্রায় ১০০টি। বিভিন্ন দপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় রয়েছে অর্ধশতাধিক। বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ের এসব সরকারি দপ্তরে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। তবে এই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ৩০০টির মতো সরকারি বাসা বা ফ্ল্যাট রয়েছে যার ২৫০টিই বসবাসের অনুপযোগী।
প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল নগরীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বিশেষ করে মাঠ প্রশাসন ও পুলিশ সদস্যদের আবাসন সংকট দীর্ঘদিনের। বিভাগ প্রতিষ্ঠার ২৮ বছর পেরিয়ে গেলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই বললেই চলে।
উল্টো বিভাগ হওয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি অনেক বিভাগীয় কার্যালয় চালু হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সেই তুলনায় আবাসনের সুযোগ খুবই সীমিত। বরিশাল নগরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। বাসা পাওয়ার যোগ্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ৮ সহস্রাধিক। কিন্তু সরকারি বাসা পেয়েছেন ৭০-৮০ জনের মতো।
কর্মকতারা আরও জানান, গত কয়েক বছরে বরিশাল নগরীতে প্রচুর মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। বিভাগীয় শহর হওয়ার কারণে একটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বেড়েছে শহরের লোকসংখ্যাও। বরিশাল ছাড়া বিভাগের অন্য জেলাগুলোতে তেমন একটা ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে অনেক অভিভাবক এখানে বাসা ভাড়া নিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছেন। এসব কারণে বাড়ি ভাড়াও আগের চেয়ে এখন প্রায় দ্বিগুণ। ফলে সরকারি কর্মকর্তারা বেতনের সঙ্গে যে টাকা বাড়িভাড়া হিসেবে পান তা দিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী বাসা পাওয়া দুরহ ব্যাপার।
মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে একজন অতিরিক্তি সচিব (বিভাগীয় কমিশনার), একজন যুগ্ম সচিব (অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার), দুইজন সিনিয়র সহকারী সচিব (সিনিয়র সহকারী কমিশনার) ও পাঁচ জন সহকারী সচিব (সহকারী কমিশনার) পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। তবে বিভাগীয় কমিশনার ছাড়া আর কোনো কর্মকর্তার জন্য সরকারি আবাসনের ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার মিলিয়ে ২২ জন প্রশাসনের ক্যাডার রয়েছেন। তাদের মধ্যে জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ছাড়া অন্য কর্মকর্তাদের সরকারি কোয়ার্টারের ব্যবস্থা নেই।
নাম না প্রকাশের শর্তে মাঠ প্রশাসনের তিনজন কর্মকর্তা জানান, সরকারি আবাসন সুবিধা না থাকায় নগরীর বিভিন্ন স্থানে কর্মকর্তাদের বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হচ্ছে। এক সঙ্গে থাকার উপায় নেই। এতে ঝুঁকি রয়েছে। কারণ ভাড়া বাসায় নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। এতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
তারা বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তাছাড়া গত ১৮ জুলাই বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমানের সরকারি বাসভবনে হামলার ঘটনায় মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
তারা আরও বলেন, ঝুঁকি বিবেচনা করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারি আবাসনের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। কর্মস্থল থেকে ফিরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেন পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদ একটি জায়গায় থাকতে পারেন সে বিষয়ে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে ২০০৯ সালে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে সদস্য সংখ্যা দুই সহস্রাধিক। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অধীনে ৪টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি থানার কার্যক্রম ভাড়া বাসায় চলছে। শুধু তাই নয়, ভাড়া বাসায় চলছে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের সদর দপ্তরসহ বেশিরভাগ ইউনিটের কার্যক্রম। নেই আলাদা পুলিশ লাইন্স। সদস্যদের জেলা পুলিশ লাইন্সের ব্যারাকে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। সরকারি আবাসনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
কোতয়ালি মডেল থানা কম্পাউন্ডে রয়েছে মাত্র ৬টি কোয়ার্টার। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৪ শতাধিক কর্মকর্তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে গিয়ে এবং সন্ত্রাসী, অপরাধী, মামলার আসামি ধরতে গিয়ে মাঝে মধ্যে হুমকির শিকার হচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা। সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কিন্তু পুলিশ সদস্যদের আবাসনসহ নানা সমস্যা রয়েছে। ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে। এতে ঝুঁকি রয়েছে।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খান (পিপিএম) জাগো নিউজকে জানান, জনগণের নিরাপত্তায় নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে মোট্রোপলিটন পুলিশ। কিন্তু সেই পুলিশ সদস্যদের আবাসন সমস্যা দীর্ঘদিনের। তবে বরিশাল মোট্রোপলিটন পুলিশের জন্য নগরীর রূপাতলী এলাকায় পুলিশ লাইন্স নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। সেখানে পুলিশ সদস্যদের পরিবার নিয়ে থাকার জন্য বেশকিছু ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। আশা করছি এরপর আবাসন সংকট অনেকাংশে দূর হবে।
এদিকে গণপূর্ত অধিদপ্তর বরিশাল কার্যালয়ের তথ্যমতে, ৮২টি সরকারি কোয়ার্টারের মধ্যে ৭৯টি খালি রয়েছে। কারণ সেগুলো বসবাসের অনুপযোগী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। দেয়ালে ছোট-বড় একাধিক ফাটল। বৃষ্টি হলে ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। বিবর্ণ দেয়ালে জমেছে শ্যাওলা। দীর্ঘদিন পরিষ্কার না হওয়ায় বিল্ডিংগুলোর পাশে লতা-পাতা ও আগাছা জন্ম নিয়েছে। এ রকম ভবনেই হাতে গোনা কয়েকজন কর্মচারী বসবাস করছেন।
অন্যদিকে আবাসন সংকটের কারণে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বেশিরভাগ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও কর্মচারীকে থাকতে হচ্ছে ভাড়া বাসায়।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে বর্তমানে চিকিৎসকের সংখ্যা ২৩৩ জন। সরকারি বাসার সংখ্যা মাত্র ৩৯টি। হাসপাতালে তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যা ১১৬ জন। স্বাধীনতার আগে নির্মিত কর্মচারীদের অধিকাংশ বাসা বসবাসের অনুপযোগী। সেকারণে তাদের ভাড়া বাসায় থাকতে হচ্ছে।
এছাড়া বরিশাল আদালতের বিচারকদের আবাসন সংকট দীর্ঘদিনের। জেলা ও দায়রা জজ আদালত, বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল, জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মিলিয়ে বর্তমানে বিচারকের সংখ্যা ৪৬ জন। তবে আবাসনের ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ১৩ জনের।
এসব বিষয়ে বরিশাল গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জেরাল্ড অলিভার গুডা জানান, বরিশাল নগরীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা অপ্রতুল। আবার অনেক সরকারি কার্যালয়ের নিজস্ব ভবন নেই। নগরীতে এ ধরনের ১৮টি দপ্তরের কার্যালয় নির্মাণে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও এর অধীন বিভিন্ন দপ্তর বা সংস্থার জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে পরবর্তীতে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন সমস্যার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে।
এফএ/এমএস