যশোর শিক্ষাবোর্ড: চার বছরে ৫ কোটি টাকা হাতিয়েছে জালিয়াত চক্র
যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডে চার বছর ধরে সক্রিয় চেক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত একটি চক্র। এ সময়ে চক্রটি প্রায় পাঁচ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে এ টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে। চক্রের সদস্য বোর্ডের হিসাব সহকারী আবদুস সালাম এবং প্রতারক প্রতিষ্ঠান ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শরিফুল ইসলাম বাবু ও শাহীলাল স্টোরের মালিক আশরাফুল আলমের মাধ্যমে এ টাকা উত্তোলিত হয়েছে।
এ ঘটনায় দুদকের দায়েরকৃত মামলায় এ তিনজনের সঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব অধ্যাপক এএমএইচ আলী আর রেজাকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। দুদক জালিয়াতি ও টাকা আত্মসাতের পুরো বিষয়টি তদন্ত করছে।
শিক্ষাবোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যশোর বোর্ডে ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট থেকে শুরু করে চলতি বছর ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জালিয়াত চক্র ২৬টি চেকের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৭৪২ টাকার বিপরীতে পাঁচ কোটি ৯ লাখ ৪৯ হাজার ৮৯৮ টাকা উত্তোলন করেছে। ফলে জালিয়াত চক্রের হাতে চলে গেছে চার কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৫৬ টাকা।
বোর্ডে গত ৭ অক্টোবর প্রথম চেক জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। ৯টি চেকের মাধ্যমে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ও শাহী লাল স্টোর দুই কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকা উত্তোলনের বিষয়টি ধরা পড়ায় ১০ অক্টোবর দুদকে অভিযোগ করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এরপর ২১ অক্টোবর আরও দুই কোটি ৪৩ লাখ সাত হাজার ৮৭৮ টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে।
এর আগে ১৮ অক্টোবর আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করে দুদক। দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল এ মামলা করেন। অভিযুক্তরা হলেন, যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন, সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজা, হিসাব সহকারী আবদুস সালাম, প্রতারক প্রতিষ্ঠান ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক রাজারহাট এলাকার বাসিন্দা আবদুল মজিদ আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম বাবু ও শেখহাটী জামরুলতলা এলাকার শাহীলাল স্টোরের মালিক মৃত সিদ্দিক আলী বিশ্বাসের ছেলে আশরাফুল আলম। মামলা হবার পর ওইদিন রাতেই চেয়ারম্যান ও সচিব তাদের বাংলো থেকে বের হয়ে যান। এরপর থেকে তারা অফিসও করছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেশিরভাগ টাকা বোর্ডের হিসাব সহকারী আবদুস সালাম, নামসর্বস্ব প্রতারক প্রতিষ্ঠান ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শরিফুল ইসলাম বাবু ও শাহীলাল স্টোরের মালিক আশরাফুল আলমের মাধ্যমে উত্তোলিত হয়েছে।
পাঁচটি চেকে শহরের জামে মসজিদ লেনের নূর এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক একাউন্টে জমা পড়েছে ৬৬ লাখ ১০ হাজার ৮৯৫ টাকা। জামে মসজিদ লেনে এ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শহরের প্রধান ডাকঘরের সামনের এই নূর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী নূর ইসলাম জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু কেনাকাটা করেছেন বোর্ডের হিসাব সহকারী আবদুস সালাম। আবদুস সালাম ও শরিফুল ইসলাম বাবু জামে মসজিদ লেনের ঠিকানা দিয়ে প্যাড তৈরি করে ব্যবহার করেছেন। তার ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের একাউন্টে ওই টাকা জমা হয়েছে। পরে আবদুস সালামের দেয়া একাউন্টে তিনি ওই সব টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন। এ জালিয়াতি বা অর্থ আত্মসাতের কিছুই তিনি জানেন না।
শহরের মাইকপট্টি এলাকার অর্পানেট কম্পিউটারের নামে দু’টি চেকে উত্তোলিত হয়েছে সাত লাখ ৯৫ হাজার ৬৪৬ টাকা। অর্পানেট কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী আক্তারুজ্জামান জানান, তিনি বোর্ডে কোনো মালামাল সরবরাহ করেননি। ভেনাস প্রিন্টিংয়ের শরিফুল ইসলাম বাবু তার নাম ব্যবহারে পণ্য সরবরাহের কথা জানিয়েছিলেন। পরে বাবু তার একাউন্টে একটি চেক জমা দিয়ে তিন লাখ ৩১ হাজার ২৩৯ টাকার পুরোটাই নিয়ে নেন। এছাড়া প্রথম দফায় ধরা পড়া দুই কোটি ৫০ লাখ ৪৪ হাজার ১০ টাকার মধ্যে এক কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার ১০ টাকা উত্তোলিত হয়েছে ভেনাস প্রিন্টিংয়ের শরিফুল ইসলাম বাবুর ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের একাউন্ট থেকে। বাকি ৬১ লাখ ৩২ হাজার টাকা উত্তোলিত হয়েছে শাহী লাল স্টোরের আশরাফুল আলমের মাধ্যমে।
এদিকে গত চার বছর ধরে এ জালিয়াতি অব্যাহত থাকায় প্রশ্নে উঠেছে বোর্ডের অভ্যন্তরীণ অডিট ফাঁকি দিয়ে কীভাবে জালিয়াতি চক্র পার পেয়ে গেল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বোর্ড চেয়ারম্যান, সচিব ও হিসাব সহকারীর নেতৃত্বে সিন্ডিকেট এ অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকায় জালিয়াতির বিষয়টি ধাপা চাপা পড়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক এমদাদুল হক বলেন, আবদুস সালাম (হিসাব সহকারী) আগে অডিট শাখায় কর্মরত ছিলেন। তিনি জালিয়াতির বিষয়টি ফাঁকি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর ও সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনিচ্ছাকৃত ভুলে জালিয়াতির বিষয়টি নজর এড়িয়ে গেছে। অডিট শাখায় নতুন লোক নিয়োগ হয়েছে। তিনি চেক যাচাই-বাছাই করতে গিয়ে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়েছে। এ পর্যন্ত চেক জালিয়াতির মাধ্যমে চার কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৫৬ টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত জানান, ইতোমধ্যে শিক্ষাবোর্ডের চেক জালিয়াতির মাধ্যমে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পাঁচজনের নামে মামলা হয়েছে। আরও প্রায় আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছি। পূর্বে দায়েরকৃত মামলার তদন্তে নতুন করে পাওয়া অভিযোগের বিষয়টি সংযুক্ত হবে। দুদক পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখছে। তদন্তের জন্য নির্ধারিত সময় রয়েছে। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যেই তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
সূত্র অনুযায়ী, প্রথম জালিয়াতির ঘটনা ঘটে ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট। এদিন বিজনেস আইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নামে আয়কর বাবদ ১২ হাজার ২৭৬ টাকার বিপরীতে পাঁচ লাখ ৭০ হাজার ৮৩৪ টাকা তুলে নেওয়া হয়। একই সালের ৪ অক্টোবর শহরের জামে মসজিদ লেনের নূর এন্টারপ্রাইজ নামে ৫৮ হাজার ৩৫ টাকার পণ্য সরবরাহের বিপরীতে চার লাখ ৮৫ হাজার ৩৫ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল মেসার্স খাজা প্রিন্টিং প্রেসের নামে দুই লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকার বিপরীতে চার লাখ ৭৪ হাজার ৪৩০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই তারিখে নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে দুই লাখ ৯৮ হাজার ৫৩০ টাকার বিপরীতে চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৩০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২০১৯ সালে ৮ জুলাই নূর এন্টারপ্রাইজের নামে ৮১ হাজার ৪৭৬ টাকার বিপরীতে ১৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ১৯ আগস্ট সামিয়া ইলেকট্রনিক্সের নামে ৫৫ হাজার ৭৬২ টাকার বিপরীতে ৩০ লাখ ৮৯ হাজার ৯০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই বছরের ৭ অক্টোবর সেকশন অফিসার আবুল কালাম আজাদের নামে ইস্যুকৃত ৯৪ হাজার ৩১৬ টাকার বিপরীতে ৩০ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ২৬ নভেম্বর নূর এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যুকৃত ৭৮ হাজার ৭০৭ টাকার বিপরীতে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি মিম প্রিন্টিং প্রেসের নামে ইস্যুকৃত ২০ হাজার ২৪০ টাকার বিপরীতে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই বছরের ৪ মার্চ সাধারণ সহকারী (বর্তমানে হিসাব সহকারী) আবদুস সালামের নামে ইস্যুকৃত ছয় হাজার ১৯৫ টাকার চেকের বিপরীতে ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই বছরের ১২ মার্চ শাহী লাল স্টোরের নামে ইস্যুকৃত ১১ হাজার ১৯৯ টাকার চেকের বিপরীতে ৩৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
২০২০ সালের ৮ জুলাই আয়কর বাবদ দুই হাজার ৫০০ টাকার চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং প্যাকেজিং ২৫ লাখ ৮০ হাজার ১০ টাকা উত্তোলন করেছে। একইভাবে ১২ আগস্ট ভ্যাট বাবদ এক হাজার ২০৭ টাকার চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস। ২৪ আগস্ট আয়কর বাবদ ৬০০ টাকার চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে শাহী লাল স্টোর নামে একটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা উত্তোলন করে নিয়েছে। ৩১ আগস্ট নূর এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যুকৃত ৯২ হাজার ৩৪৬ টাকার চেকের বিপরীতে চার লাখ ৭৪ হাজার ৪৩০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। ১২ নভেম্বর নূর এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যুকৃত ১৬ হাজার ৮৩৩ টাকার চেকের বিপরীতে উত্তোলন করা হয়েছে চার লাখ ৬৪ হাজার ৪০৩ টাকা। ১৬ নভেম্বর আয়কর বাবদ ৬৭৮ টাকার চেকের নম্বর ও তারিখ ব্যবহার করে জালিয়াতির মাধ্যমে ২৫ লাখ ৪২ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে শাহী লাল স্টোর। ১৯ নভেম্বর ভ্যাট বাবদ ৬০০ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং। ১৭ ডিসেম্বর শরীফ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে ইস্যুকৃত দুই লাখ ৯৮ হাজার ৬৫০ টাকার চেকের বিপরীতে চার লাখ ৬৪ হাজার ৪৫০ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
২০২১ সালের ৬ মে ভ্যাট বাবদ ৯৯৬ টাকার চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ১৩ জুন অর্পানেটের নামে ইস্যুকৃত ২১ হাজার ১৭৭ টাকার চেকের বিপরীতে চার লাখ ৬৪ হাজার ৪০৭ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই বছরের ২৯ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৭২৫ টাকার চেক ইস্যু করা হয়। ওই চেক জালিয়াতি করে ৪২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ৩০ জুন ভ্যাট বাবদ এক হাজার ৮০ টাকার চেক জালিয়াতি করে ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। ১৩ সেপ্টেম্বর অর্পানেটের নামে ইস্যুকৃত ২৭ হাজার ৭৫৮ টাকার চেকের বিপরীতে তিন লাখ ৩১ হাজার ২৩৯ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। একই দিন আয়কর বাবদ বোর্ড ৬৫০ টাকার চেক ইস্যু করে। এই চেক জালিয়াতি করে ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে।
যশোর শিক্ষাবোর্ডের কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমীর হোসেন ও হিসাব সহকারী আবদুস সালামের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে চেক জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেছে। তাদের স্বপদে বহাল রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত সম্ভব নয়। অর্থ আত্মসাতে যাদের নামে এসেছে, তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করলে কোটি কোটি টাকা জালিয়াতির পুরো তথ্য বেরিয়ে আসবে।
মিলন রহমান/আরএইচ/এমএস