ঠাকুরগাঁওয়ে শিশুদের ঝরে পড়ার হার বেড়েছে
১২ বছর বয়সী শুভ। গভীর মনোযোগ দিয়ে ঠাকুরগাঁও শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার একটি মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করছে। স্কুলে না গিয়ে এখানে কেন জানতে চাইলে শুভর চোখে পানি চলে আসে।
শুভ জানায়, করোনায় স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে বাবা আমাকে এখানে কাজ শেখার জন্য দিয়ে যান। আমি ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি। রাস্তা দিয়ে ছেলে-মেয়েরা স্কুলে যাওয়ার সময় খারাপ লাগে। আবারও স্কুলে যেতে মন চায়।
শুধু শুভ নয়, করোনায় তার মতো অনেক শিশুর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে। কাজ করছে বিভিন্ন গ্যারেজ, ওয়ার্কশপে। পরিবারের আয় বাড়ানোর তাগিদে স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের কাজে দিয়েছেন অভিভাবকরা। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন কারখানা, ওয়ার্কশপ, মুদি দোকান, হোটেল ও পরিবহনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে শিশুরা।
গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজে যোগ দেয় সজিব ইসলাম। সে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা গড়েয়া লস্করা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। বাবা তাকে কাজের জন্য পরিচিত শহরের এ ওয়ার্কশপে দিয়েছেন। এখন সে নিজে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি বাড়িতেও টাকা পাঠায়।
কষ্টে রয়েছে করোনাকালে কিন্ডারগার্টেন ও নন-এমপিও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গত দেড় বছরে বেশিরভাগ স্কুলেরই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এসব স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী নানা কাজে যুক্ত হয়েছে, স্থানান্তরিত হয়েছে অনেকে।
এছাড়াও অনেক ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক বেশি। এ শিক্ষার্থীরা আর কখনো শিক্ষার আলো দেখবে না বলে অভিমত তাদের সংশ্লিষ্টদের।
ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিও নামে একটি বেসরকারি সংস্থার করা জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৮ শতাংশ শিক্ষকের মতে বিদ্যালয় খেলার পর ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি কমে গেছে। আর মাধ্যমিক স্কুলের ৪১ দশমিক ২ শতাংশ শিক্ষক মনে করেন স্কুল খোলার পর শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার বেড়েছে। এনজিও কর্মকর্তার মতে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার ও ঝরে পড়া বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আরজুমান আরা বেগম বলেন, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে সরকারের একটা প্রণোদনা দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থী যেন ঝরে না পড়ে সেজন্য সরকারকে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরেজমিনে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, স্কুল-কলেজ খোলার পর কী কী করতে হবে সে সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ করতেও নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মনতোষ কুমার দে নামে ঠাকুরগাঁওয়ের এক শিক্ষাবিদ বলেন, যেখানে ধার করে সংসার চালাচ্ছেন, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যাপারটি মাথায়ই রাখেননি। এসব দরিদ্র পরিবারের অনেক সন্তান শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে। যারা আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে।
ঠাকুরগাঁও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আলাউদ্দিন আজাদ বলেন, করোনার মধ্যেও আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কিছুটা বেড়েছে। তবে সমস্যা হতে পারে বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনে। তবে কোনো শিক্ষার্থী যাতে ঝরে না পড়ে সেজন্য আমরা প্রাথমিকে ভর্তি উন্মুক্ত করে দিয়েছি। আমাদের উপবৃত্তি ও মিড-ডে মিল চালু আছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের দরিদ্র পরিবারও যাতে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আসে সে ব্যাপারে শিক্ষকরা সহায়তা করবেন।
এ প্রসঙ্গে ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক মাহবুব রহমান বলেন, শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে আমরা করোনার সময়েও শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিচ্ছি। বৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা শর্তই আছে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ক্লাসে আসা।তাই স্কুল খোলার পর কোনো শিক্ষার্থী না এলে আমরা সহজেই বের করতে পারব। এছাড়া প্রত্যেক স্কুল থেকেই তার সব শিক্ষার্থীকে ক্লোজ মনিটরিং করা হবে। ফলে আমরা ঝরে পড়ার কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারব।
তানভীর হাসান তানু/আরএইচ/এমএস