ভিডিও EN
  1. Home/
  2. দেশজুড়ে

ঘোড়ায় ভাগ্য ফিরছে ঢালারচরবাসীর

আমিন ইসলাম জুয়েল | প্রকাশিত: ০৯:২৪ পিএম, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

পাবনা শহর থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে পাবনা, রাজবাড়ী ও মানিকগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচর। প্রত্যন্ত এ জনপদে বর্ষায় এখনো পালতোলা নৌকা চলে। যদিও এক সময় পদ্মা-যমুনা তীরবর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঢালারচরের কথা শুনলে মানুষ আঁতকে উঠতো। খুন-সন্ত্রাসে ভরা ছিল বলে নাম হয়েছিল রক্তাক্ত ঢালারচর। সেই ঢালারচরে এখন আলোর হাতছানি। এখানকার মানুষ বিভিন্ন পেশায় সফল হয়েছেন। এমনই একটি পেশা ঘোড়া পালন। ঘোড়া লালন-পালন, তা বিক্রি এবং ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে এলাকার অনেক মানুষ এখন স্বাবলম্বী। ঢালারচরের ঘোড়ার সুনাম এখন দেশব্যাপী।

পাবনার ঢালারচরে ২২টি গ্রামে প্রায় ২৫ হাজার লোকের বাস। তাদের প্রধান পেশা কৃষি এবং মাছ ধরা। বর্ষার সময় নৌকা বা ট্রলার ছাড়া যাতায়াত করা যায় না। শুষ্ক মৌসুমে ক্ষেতের আলপথে হাঁটতে হয়। দুর্গম জায়গা বলে এক সময় ঢালারচর ছিল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। ২০০১ সাল পর্যন্ত এক দশকে এখানে পাঁচ পুলিশ সদস্যসহ অর্ধশতাধিক মানুষ চরমপন্থীদের হাতে খুন হয়েছিলেন। সেই ঢালারচরের কথা শুনলে পিলে চমকে ওঠারই কথা। আশার কথা, সেই চরে এখন বইছে বদলে যাওয়া হাওয়া। যে দুর্গম চরের একমাত্র বাহন ছিল ঘোড়ার গাড়ি, সেই ঘোড়ার গাড়ি চালনা ও ঘোড়া পালনই এখন বহু মানুষকে সচ্ছল করেছে।

ঘোড়া লালন-পালন করে পারিবারিক সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন ঢালারচরের চর নতিবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের বাসিন্দা আব্দুল মজিদ। লোকে যাকে এখন ‘ঘোড়া মজিদ’ নামেই চেনেন। তার ছেলে শাহীন মোল্লা জানান, ঘোড়া লালন-পালন করে তারা পারিবারিক সচ্ছল। তারা শুধু নিজেরা সচ্ছল হননি। তাদের দেখাদেখি বহু মানুষ ঘোড়া পালন করে সচ্ছল হয়েছেন। ঘোড়ার আকার ও জাতভেদে দামের তারতম্য রয়েছে বলে জানান তিনি।

jagonews24

তিনি বলেন, ঘোড়া লালন-পালন করা খুব কঠিন নয়। গরু যা খায় না, ঘোড়া তাও খায়। তাছাড়া এখানে ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে লালন পালনের একটা বাড়তি সুবিধা আছে। শুধু বর্ষাকালে একটু সমস্যা। তারপরও ঘোড়াওয়ালারা পানি পাড়ি দিয়ে জেগে থাকা চরে অনেক ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে আসেন। ঘোড়া জলমগ্ন ঘাসও খায়। চলতি বর্ষা মৌসুমেও অনেক ঘোড়া যমুনার গহীন চরে রেখে আসা হয়েছে বলে জানান তিনি।

শাহীন বলেন, তারা এলাকার পুরোনো ঘোড়াচাষি বলে তাদের কাছে লোকজন ঘোড়া লালন-পালনের কথা জানতে চান। তারা সানন্দে আগ্রহীদের তা জানিয়ে দেন।

এলাকার শিক্ষিত তরুণ ঢালারচর ইউনিয়নের মিরপুর এলাকার আবু হানিফ জানান, ঢালারচরের বিস্তীর্ণ বালুচরে ধান, পাট, বাদাম, মরিচ, মিষ্টিকুমড়া চাষ হচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করা চরের সংগ্রামী মানুষেরা যমুনা পাড়ে ফলাচ্ছেন সোনার ফসল। সেই ফসল ঘরে আনার একমাত্র বাহন ঘোড়ারগাড়ি। ঘোড়ারগাড়ি চালানোর পাশাপাশি ঘোড়া লালন-পালন করে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন চরের আব্দুল লতিফ। তিনি জানান, ১১ বছর ৮ মাস ধরে ঘোড়ারগাড়ি চালাচ্ছেন। পাশাপাশি ঘোড়া লালন-পালন করে সংসারে সমৃদ্ধি এনেছেন।

jagonews24

আজিজুল কাজীর ছেলে আজাদ কাজী (৫০) বলেন, তারা ছয় ভাই-বোন। পৈতৃক সম্পদ বলতে কিছুই পাননি। তিনি এক সময় মহিষের গাড়ি চালাতেন। কিন্তু মহিষের দাম বেড়ে যাওয়ায় মহিষের গাড়ি চালনো বাদ দিতে হয়। বছর তিনেক হলো তিনি ঘোড়া লালন-পালন করছেন এবং ঘোড়ারগাড়ি চালাচ্ছেন।

তিনি জানান, অল্প পুঁজি অনুযায়ী ঘোড়ারগাড়ি অনেক লাভজনক। ঘোড়া লালন-পালন করেও তিনি চলছেন। ঘোড়ার ওপরই তার সংসার চলছে। তিনি তার ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়াও শেখাচ্ছেন।

কথা বলছিলাম আব্দুল মাজেদের (৫২) সঙ্গে। তিনি জানান, বাড়িতে একটি ঘোড়া বাঁধা রয়েছে আরও চারটি রয়েছে চরে। ঘোড়ারগাড়ি চালিয়ে ও ঘোড়া বিক্রি করেই সংসার চলছে। ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন।

jagonews24

এক যুগ ধরে ঘোড়ারগাড়ি চালাচ্ছেন সুজন (৪০)। তিনি জানান, পুরুষ ঘোড়া দিয়ে মালামাল টানাতে সুবিধা। মাদি ঘোড়া যেহেতু বাচ্চা দেয় তাই সেদিক দিয়ে এটাও লাভজনক। তিনি ঘোড়ারগাড়ি চালানোর পাশাপাশি ঘোড়া পালন করে বিক্রি করেন।

ঘোড়ার খামারি মজির আলী জানান, তিনি ঘোড়ার খামার করেছেন। ছোট ছোট ঘোড়ার বাচ্চা কিনে বড় করে বিক্রি করেন। তিনি এ প্রতিনিধির সামনেই ৬৫ হাজার টাকায় একটি ঘোড়া বিক্রি করেন। ঘোড়াটি কিনেছিলেন কম দামে। সেটা লালন-পালন করে তিনি বড় করে বিক্রি করলেন বলে জানান। তার মতো আরও তরুণ বেকাররাও ঘোড়া চাষে এগিয়ে এসেছেন বলে জানান।

গাড়ির জন্য যেমন অনেকে ঘোড়া কিনতে আসেন তেমনি অনেক শৌখিন লোক কিংবা পেশাজীবী আসেন ঘোড়া কিনতে। পাবনা জেলা এবং জেলার বাইরে থেকেও অনেকে ঢালারচরে ঘোড়া কিনতে আসেন। কথা হয় জহুরুল হকের (৪৫) সঙ্গে। তিনি সুজানগর উপজেলার কয়া গ্রামের বাসিন্দা। জহুরুল হক বলেন, তিনি ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে ঘোড়াটি কিনেছেন। তারা ঘোড়ায় চরে ঘুরে দেখছেন সেটি উপযুক্ত কিনা।

jagonews24

সরেজমিনে ঢালারচর ঘুরে দেখা গেছে, বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি গৃহিণীরাও ঘোড়া দেখাশোনা করেন। এতে সংসারে বাড়তি আয় আসায় তারা লাভবান হচ্ছেন।

ঢালারচর ইউনিয়নের ব্যবসায়ী আব্দুল হালিম সরদার জানান, ঢালারচরে আসা নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক সময় চরম ভীতি কাজ করতো। এ ভয় এখন অমূলক।

তিনি বলেন, চরের মানুষ অনেক সহজ-সরল। তারা ভালো জীবিকা পেলে বিপথে পা বাড়ায় না। তাদের অনেকেই যেমন ঘোড়া পালনে মনোনিবেশ করেছেন তেমনি তারা এ কাজে বেশ লাভবানও হচ্ছেন।

ঢালারচর ইউপি চেয়ারম্যান কোরবান আলী সরদার জানান, তারা ঢালারচরকে রক্তাক্ত দ্বীপ থেকে আলোকিত জনপদে রূপান্তরে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করছেন।

jagonews24

তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে মানুষ কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। তার ইউনিয়ন পরিষদেরই কর্মচারী (চৌকিদার) আব্দুল মজিদ ঢালারচরে ঘোড়ার খামার করে নিজে লাভবান হয়েছেন। তার দেখাদেখি অন্যরাও লাভবান হচ্ছেন।

পাবনা জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মণ্ডল জানান, ঘোড়া একটি নিরীহ প্রাণী। এর তেমন রোগ-বালাই নেই। খাবারেও খুব একটা বাছবিচার নেই। ঘোড়ারগাড়ি করা যেমন লাভজনক তেমিন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘোড়ার খামার করাও লাভজনক।

তিনি বলেন, ঢালারচরের অবারিত মাঠ ঘোড়ার উপযুক্ত চারণভূমি। ফলে ঘোড়া পালন করে অনেকেই লাভবান হচ্ছেন। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।

এসএইচএস/জেআইএম