১৫ বছর ধরে গরিবের সেবায় ‘ইয়াকুব ভাই’
জয়পুরহাটে হতদরিদ্র মানুষদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন সদর উপজেলার সিট হরিপুর গ্রামের সুক্টিপাড়া এলাকার সত্তর বছর বয়সী ইয়াকুব আলী। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ ধরে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসাসহ মানবিক সেবা করতে গিয়ে নিজের জমিজমা বিক্রি করে এখন তিনিও দাঁড়িয়েছেন দরিদ্রদের সারিতে। তারপরও থেমে নেই তার মানবসেবা।
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি ঘুরে দরিদ্র পরিবারের শিশু ও নারী-পুরুষের মাঝে ওষুধ বিতরণ (চিকিৎসকের পরামর্শপত্র দেখে) করেন এই বৃদ্ধ।
প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ডিগ্রি না থাকলেও জয়পুরহাট শহর থেকে শুরু করে সদর উপজেলার আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা তাকে চেনেন ‘বিনামূল্যের চিকিৎসক ইয়াকুব ভাই’ হিসেবে। দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের কাছে তিনি ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে রোগীদের খোঁজখবর নিয়ে শুরু হয় তার দিন। এরপর রোগীর অবস্থা অনুযায়ী তাকে নিয়ে যান কোনো পল্লীচিকিৎসকের কাছে। জরুরি হলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে। পরে চিকিৎসকদের পরামর্শপত্র দেখে ওষুধ সংগ্রহ করে পায়ে হেঁটে তা রোগীদের বাড়িতে পৌঁছে দেন। ১৫ বছর ধরে এভাবে মানবসেবা করতে গিয়ে তাকে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিও বিক্রি করতে হয়েছে বলেও জানালেন এলাকাবাসী।
ইয়াকুব আলী এখন ৭০ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ। মৃত শুকুর আলী মণ্ডল ও মৃত বুদিমন বেওয়ার মেজো ছেলে তিনি। বাবা কৃষিকাজ করতনে। মা ছিলেন গৃহিণী। বাবার রেখে যাওয়া অল্প কিছু জমিতে তিনি নিজেও কৃষিকাজ করা ছাড়াও আর্টিস্টের কাজ করেন। চার বছর আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। ইয়াকুব আলীর তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে জুতার দোকানে কাজ করেন। ছোট ছেলে নাহিদ একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন।
পার্শ্ববর্তী স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন ইয়াকুব। পরিবারে অভাবে থাকায় লেখাপড়া বেশিদূর এগোয়নি। পরে নিজেকে মানবসেবায় নিয়োগ করেন। ১৫ বছর ধরে ২০-২৫টি গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থ মানুষের খোঁজ নিয়ে আসছেন। এমনকী সীমান্তবর্তী ভারতের দরিদ্র নাগরিকদের কাছেও তিনি ওষুধ পৌঁছে দেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
ইয়াকুব আলী মানবসেবা করতে গিয়ে এখন নিজেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সংসারের প্রয়োজনে কৃষি ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে না পেরে জেলও খেটেছেন। শারীরিক জটিলতায়ও ভুগছেন। তবে টাকার অভাবে অনেক সময় ওষুধ কিনে খেতে পারেন না।
ভাদসা ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ও যুবলীগের সভাপতি ছিলেন ইয়াকুব আলী। সদর থানা যুবলীগের এক নম্বর সহ সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য।
সদর উপজেলার ভাদসা ইউনিয়নের ছিট বজরুক গ্রামের আমেনা বেগম ও মুকুল হোসেন, হরিপুর গ্রামের পেয়ারা বেগম ও নুরুন্নাহার বেগম, ভাদসার নজরুল, খঞ্জনপুর এলাকার আবু জাহের হাবুসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, মানবসেবা করতে গিয়ে এখন নিজেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন ইয়াকুব ভাই। দরিদ্র মানুষগুলোর চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে আজ তিনি নিঃস্বপ্রায়।
তিন বছর আগে ইয়াকুব আলীর স্ত্রী মারা গেছেন। এখন তার দুই ছেলেসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কয়েকজন তাকে সহায়তা দিচ্ছেন। ইয়ায়ুব আলী বলেন, যতদিন বেঁচে থাকব এই কাজ করে যাবো। মানবসেবা করে আনন্দ পাই, দরিদ্ররা দোয়া করে—এটাই আমার তৃপ্তি।
ভাদসা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরোয়ার হোসেন স্বাধীন জানান, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হলেও বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে মানুষদের কাছে ওষুধ পৌঁছে দেন ইয়াকুব আলী। তার এ কাজটি অবশ্যই প্রশংসনীয়।
জয়পুরহাট পৌরসভা মেয়র মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তাক বলেন, দরিদ্র ইয়াকুব আলী মহৎ কাজ করছেন। তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসা উচিত।
রাশেদুজ্জামান/এসআর/জেআইএম