জয়পুরহাট হানাদার মুক্ত দিবস আজ
আজ ১৪ ডিসেম্বর। জয়পুরহাট হানাদার মুক্ত দিবস। এই দিনে সাবেক কমান্ডার প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আছাদুজ্জামান বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা তৎকালীন ডাকবাংলো মাঠে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করে জয়পুরহাটকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন।
এ সময় জেলার বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকা পাকসেনারা প্রাণ ভয়ে বগুড়া, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। এর আগে তখনকার জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর ও ক্ষেতলাল থানার বিভিন্ন এলাকায় হানাদাররা যে তাণ্ডব চালায় তা স্মরণ করলে আজও শিউরে ওঠে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। শুরুর দিকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জয়পুরহাট সরকারি কলেজ, ডাক্তারখানা মাঠ (শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান) পাঁচবিবির ফুটবল মাঠ ও আক্কেলপুর হাইস্কুল মাঠে বড় সভা-সমাবেশ ছাড়াও স্বাধীনতার জন্য সারা দেশের সঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠে জয়পুরহাট।
জয়পুরহাট সদর :
১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল পাকসেনারা গভীর রাতে বগুড়ার সান্তাহার থেকে ট্রেনযোগে এসে দখল করে নেয় তৎকালীন মহকুমা শহর জয়পুরহাটকে। ২৫ এপ্রিল থেকে শুরু হয় হানাদার বাহিনীর অগ্নি সংযোগ, ধর্ষণ আর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই ডা. আবুল কাশেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার নাম অনুসারে জয়পুরহাটের কেন্দ্রবিন্দুতে যে মাঠটি আছে তার নাম রাখা হয় শহীদ ডাক্তার আবুল কাশেম ময়দান। জয়পুরহাট শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ১৯৯১ সালে নির্মাণ করা হয় জয়পুরহাট স্মৃতি সৌধ। মৃক্তিযুদ্ধের বছর ৭১ এর সঙ্গে মিল রেখে স্মৃতিসৌধের উচ্চতা করা হয় ৭১ ফুট।
কড়ই কাদিপুর বধ্যভূমি :
জয়পুরহাট শহর থেকে ৫কি.মি. পূর্বে সদর থানাধীন বম্বু ইউনিয়নের কড়ই ও কাদিপুর নামের ছোট দুটি গ্রামে ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সোমবার ১০টার দিকে স্থানীয় রাজাকার, আলবদরদের সহায়তায় হানাদাররা প্রায় ৩ শত ৭১ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মৃৎশিল্পীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এসব শহীদদের স্মরণে সম্প্রতি এখানে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ।
পাগলা দেওয়ান বধ্যভূমি :
জয়পুরহাট শহর থেকে ১৫ কি.মি. দূরত্বে পাগলা দেওয়ান অবস্থিত। গ্রামটি ভারত সীমান্তের জয়পুরহাট সদর থানার চকবরকত ইউনিয়ন চিরলা গ্রামের পাশে অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন জুম্মার নামাজ শেষে বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় ৩০০ মানুষকে ধরে এনে জবাই করে হত্যা করে এখানে পুঁতে রাখে।
এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে পাকিস্তানি বাহিনী এই গ্রাম দিয়ে প্রায় হাজার হাজার নিরীহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে নিরাপদ আশ্রয় লাভের জন্য ভারত যাওয়ার পথে ও আশে-পাশের সীমান্ত এলাকা থেকে ধরে এনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। এখনও সেখানে মাটি খনন করলে মুক্তিযোদ্ধার হাড়-গোড় পাওয়া যায়। এখনও সেখানে প্রায় ১৫ ইঞ্চি পুরু ছাদ বিশিষ্ট পাকবাহিনীর একটি কংক্রিট বাঙ্কার আছে। দেশ স্বাধীনের পর পাগলা দেওয়ানে নির্মিত হয় একটি শহীদ মিনার। পাগলা দেওয়ান ভূমিতে ১৯৯৬ সালে দুটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।
পাঁচবিবি :
১৯৭১ সালে ২০ এপ্রিল মঙ্গলবার পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথম পাঁচবিবি থানা দখল করে ওই দিন থেকে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হতাহত করে প্রচুর মানুষকে। পাঁচবিবির পুরাতন সিও অফিস, বকুলতলা, নন্দাইল ও বাগজানাসহ জেলার ১৩টি বধ্যভূমিতে ২৪ এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
ক্ষেতলাল :
১৯৭১ সালে এ থানায়ও রাজাকারদের সহায়তায় চলে পাকবাহিনীর হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ। যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার অভিযোগে এ থানার কুজাইল গ্রামের সরকারি নাজির বদিউজ্জামানকে বগুড়া অফিস থেকে ফেরার পথে পাকহানাদার বাহিনী বগুড়ার মাটিডালী মোড়ে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়া করিমপুর গ্রামের রাজাকার আব্দুল ওহাব খান (মৃত) একই গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোজাম মিয়াকে পাক সৈন্যদের কাছে ধরিয়ে দেয়। তাকে জয়পুরহাটের খঞ্জনপুর ক্যাম্পে ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ দুটি শহীদ পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করলেও খোঁজ খবর রাখেনি কেউই। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতেই বাকরুদ্ধ কণ্ঠে অঝরে কেঁদে ফেলেন শহীদ বদিউজ্জামানের বড় ছেলে শামিমুজ্জামান শামিম ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোজাম মিয়ার ছেলে বাবলু মিয়া।
আক্কেলপুর :
হানাদার বাহিনীরা জয়পুরহাট ও আশে-পাশের অঞ্চলে পৌঁছার পর তাদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে জানমালের নিরাপত্তা তথা ইজ্জতের ভয়ে জনগণ ভারতে পালিয়ে যেতে থাকে। ১৯৭১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময় পলায়নরত কিছু লোককে গাড়োয়ানরা ভারতীয় সীমানায় রেখে আসার পথে হানাদারবাহিনীরা ১৬-১৭ জন গাড়োয়ানকে আটক করে। পরে তাদের বাঁশের মোটা গোড়া দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে। এছাড়া আক্কেলপুরে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ খোকনসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকসেনারা গুলি করে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধে জয়পুরহাটে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হাজার হাজার শহীদদের মধ্যে জয়পুরহাট সদরে উপজেলায় শহীদ হয়েছেন ৫ জন। এরা হলেন-শহীদ আব্দুর রশিদ, শহীদ তফিজউদ্দিন, শহীদ নাজির হোসেন, শহীদ আজিমউদ্দিন ও শহীদ নায়েক আব্দুর রউফ। আক্কেলপুরে উপজেলায় ৫ জন শহীদ হয়েছেন। এরা হলেন- শহীদ একেএম ফজলুল করিম, শহীদ আব্দুল বারী, শহীদ আব্দুল জব্বার, শহীদ মোখলেছার রহমান ও শহীদ আয়েনউদ্দীন। পাঁচবিবি উপজেলায় শহীদ হয়েছেন ৫ জন। এরা হলেন- শহীদ ফজলুর রহমান, শহীদ সোলায়মান আলী, শহীদ নিজামউদ্দিন সরকার, শহীদ আলিমউদ্দিন ও শহীদ লোকমান হোসেন। ক্ষেতলাল উপজেলায় শহীদ হয়েছেন শহীদ ল্যান্স নায়েক লুৎফর রহমান, শহীদ বদিউজ্জামান ও মোজাম মিয়া এবং কালাই উপজেলায় শহীদ হয়েছেন শহীদ নায়েক আফজাল হোসেন।
জয়পুরহাটে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থান ৭ নম্বর সেক্টরে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ১৯৭১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক ও আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লে. কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মুখ আক্রমণে পিছু হটতে থাকে পাকসেনারা। পরাজয় নিশ্চিত জেনে রাতের আঁধারে তারা পালিয়ে যায় বগুড়ার দিকে। ১৪ ডিসেম্বর পাঁচবিবি থানার ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ভূঁইডোবা গ্রাম হয়ে জয়পরহাটে বীরদর্পে প্রবেশ করে কোম্পানি কমান্ডার আসাদুজ্জামান বাঘা বাবলুর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা।
জয়পুরহাট জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা :
মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের অকুতোভয় মুক্তিসেনাদের মধ্যে জয়পুরহাটে সদর উপজেলার ২১২ জন, পাঁচবিবি উপজেলার ১৭১ জন, ক্ষেতলাল উপজেলার ৫১ জন, কালাই উপজেলার ৮ জন ও আক্কেলপুর উপজেলার ৩৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গেজেট অনুযায়ী লিপিবদ্ধ রয়েছেন।
বর্তমানে ২৭ জন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ সন্মানী ভাতা পান ১৭৪ জন মুক্তিযোদ্ধা। এরপরও অস্বচ্ছল রয়েছেন প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। যাদের মধ্যে বয়সের ভারে সবাই প্রায় অসুস্থ। এদের মধ্যে রাজশাহী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন- জয়পুরহাট সদরের পরিমল চন্দ্র সরকার, মোয়াল্লেম হোসেন, কবির খান ও আবুল হোসেন এবং ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা মোশারফ হোসেন এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। এসব অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সাহায্যের দাবি জানান জেলাবাসী।
রাশেদুজ্জামান/এসএস/এমএস