ঈদের বাকি ৮ দিন, পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় সিরাজগঞ্জের খামারিরা
আর মাত্র কয়েক দিন পরই পবিত্র ঈদুল আজহা। এবারও করোনার মধ্যে পালিত হবে কোরবানির ঈদ। তবে গতবারের চেয়ে এ বছর সংক্রমণের অবস্থা বেশি ভয়াবহ। নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে সরকার। এমতাবস্থায় কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে সিরাজগঞ্জের খামারিরা। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, তাদের দুশ্চিন্তা ততই বাড়ছে।
এবার কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় দুই লাখ ৮৬ হাজার গবাদিপশু প্রাকৃতিকভাবে মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে, যা গত বছরের অর্ধেক। খামারিরা বলছেন, টানা দুই বছর করোনার কারণে চলতি বছর এখন পর্যন্ত তেমনভাবে পশু বিক্রি করতে পারছেন না। অন্যদিকে ভারত থেকে পশু ঢুকলে স্বপ্ন পূরণ তো দূরের কথা, পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হতে হবে খামার মালিকদের।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের যৌথ প্রচেষ্টায় চালু হয়েছে ভার্চুয়াল ‘পশুর হাট’। জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ অনলাইনে কোরবানির পশু কেনার জন্য সিরাজগঞ্জবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গরুর খামার। এসব খামারের ২০ লক্ষাধিক গবাদিপশু থেকে উৎপাদিত প্রায় সাড়ে ছয় লাখ লিটার দুধ দেশের মোট দুধের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে।
এবারের ঈদুল আজহা উপলক্ষে জেলায় গরু, মহিষ ও ছাগলসহ দুই লাখ ৮৬ হাজার গবাদিপশুকে প্রাকৃতিক ও দানাদার খাবার দিয়ে মোটাতাজাকরণ করা হয়েছে। গত বছর করোনার কারণে অনেক খামারি লোকসানে পড়ায় জেলায় এবার গরু উৎপাদন হয়েছে অর্ধেক। চলতি বছরও বিশ্বজুড়ে করোনার কারণে অনেকেই কোরবানি দিতে আগ্রহী নন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চলছে লকডাউন।
কোরবানির আগে চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বেড়ে যাওয়ায় কোরবানির পশু বিক্রি নিয়ে খামারিরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। বিধিনিষেধ শিথিল হবে কি-না, কত দিন চলবে তা নিশ্চিত নয়। পশুর হাট বসবে কি-না তাও অনিশ্চিত। সারা বছর খামারে পরিশ্রম ও বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করার পর এখন পশুর বাজার ও দাম নিয়ে শঙ্কায় খামারিরা। যানবাহন বন্ধ থাকায় বাইরে থেকে আসতে পারছে না পাইকারি গরু ব্যবসায়ীরা। অন্য বছর এ সময় ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনায় পশুর হাটগুলো মুখরিত থাকলেও চলতি বছর এখনও বন্ধ। কবে হাট বসবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। যে কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ অন্যান্য জেলার কোনো পশুর পাইকার আসেনি সিরাজগঞ্জে। এমতাবস্থায় এক-চতুর্থাংশ পশুও বিক্রি করতে পারেননি খামারিরা। অন্যদিকে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় পশু। দেশের বাইরে থেকে পশু আনা বন্ধে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন খামার মালিকরা।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের গরু খামারি নবীদুল ইসলাম জানান, তার খামারে বর্তমানে ছোট-বড় ৫০টি গরু রয়েছে। তার মধ্যে ৩০টি ষাঁড়, যা শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রি করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিন্তু তিনি হতাশ। কারণ করোনাকালে কীভাবে বিক্রি করবেন, মানুষ তো ঘর থেকে বের হচ্ছে না। হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন নবীদুল।
কালিয়া কান্দাপাড়ার তালুকদার এগ্রো ফার্মের পরিচালক রেজাউল করিম জানান, করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করা এবং চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মেয়াদ আরও এক সপ্তাহ বেড়ে যাওয়ায় এখন গরু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা। এবার কোরবানি সামনে রেখে লাভের আশায় তারা প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু লকডাউনের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পশুর দাম কমতে শুরু করেছে। যদি কোরবানিতে পশুর হাট না বসে তাহলে ন্যায্যমূল্য তারা পাবেন না। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিতে পড়তে হবে তাদের।
উল্লাপাড়ার গ্যাসলাইন হাটের পাশে অবস্থিত মা-বাবার দোয়া এগ্রো ফার্মের মালিক মতিন সরকার বলেন, চলতি বছর লাভের আশায় কোরবানির জন্য খামারে ৩৫ থেকে ৪০টি ষাঁড় মোটাতাজা করা হয়েছে। যার একেকটার মূল্য দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু এবার আর মনে হয় না লাভের মুখ দেখা হবে। যে পরিস্থিতি তাতে এবার মূলধন তোলা নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সর্বত্র লকডাউনের কারণে সব পশুর হাট বন্ধ, তাই আমরা গরুর ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, শহরে যেসব খামারি রয়েছেন তারা অনলাইনে গরু বিক্রি করছেন। আমরা প্রান্তিক খামারিরা অনলাইন তেমন একটা বুঝি না, তাই এবার আমাদের গরু বিক্রি নিয়ে টেনশনে আছি।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শাহাবুদ্দিন বলেন, সারাদেশে যে পরিমাণ গরু উৎপাদন হয়েছে তা দিয়েই দেশের গবাদিপশুর চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ বছর করোনার কারণে এখনো হাটে পশু বিক্রি করতে পারেনি খামারিরা। তবে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে অনলাইনে গরু কেনাবেচার জন্য ‘পশুর হাট’ নামে অ্যাপ খোলা হয়েছে। গরু কিনতে এ বছর হাটে যেতে হবে না। ঘরে বসে মানুষ এবার অনলাইনের মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যে কোরবানির গরু কিনতে পারবে। প্রাণিসম্পদ কার্যালয় ও জেলা প্রশাসন এ লক্ষ্যে কাজ করছে।
তিনি আরও বলেন, অনলাইনে গরু বিক্রি হওয়ায় পাইকার ও দালালরা ক্রেতাদের ঠকাতে পারবে না। মহামারির হাত থেকে রক্ষা পাবে মানুষ। স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নির্দেশনা মানার ব্যাপারে আমরা তৎপর রয়েছি। তারা গরুর হাট চালুর ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনার ওপর নির্ভর করছেন বলে জানান তিনি।
‘পশুর হাট’ অ্যাপের উদ্ভাবক সিরাজগঞ্জ জেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পশুর হাট’ অ্যাপটি শুধু কোরবানির ঈদের জন্য করা হয়নি, এই অ্যাপটি এমনভাবে ডেভেলপ করা যেন এটি সারা বছরই আমাদের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে, প্রান্তিক পর্যায়ের সব খামারির (হাঁস, মুরগি, গরু-ছাগল) কথা মাথায় রেখে অ্যাপটি ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের চেয়ে এ বছর অ্যাপটি আরও আধুনিক করা হয়েছে। এ বছর ৩০ হাজার গরু বিক্রির পরিকল্পনা করে কাজ করা হচ্ছে।
প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান আরও বলেন, ক্রেতারা ঘরে বসে অনলাইনে এ ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পশু কিনতে পারবেন। অ্যাপে খামারির নাম, পশুর ছবি, আকার, রঙ, ওজন, উচ্চতা, দাঁত, জাত, দাম, বয়স এবং মুঠোফোন নম্বর দেয়া থাকবে। খামারিদের প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে স্মার্ট খামারি তৈরিতে ‘পশুর হাট’ অ্যাপটি যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মূলত স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পশুর হাটে ক্রেতাদের ভিড় করা নিরুৎসাহিত করতেই এই ডিজিটাল হাটের আয়োজন। কেউ গরু কিনলে সময় মতো আমাদের নিজস্ব পরিবহনের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
এআরএ/এমএস