নওগাঁয় সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের ধুম
নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-চাষিরা ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষ প্রকল্পের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করছেন। এতে বেকারদের কর্মস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মধু গুণগত ভাল হওয়ায় ভারতসহ কয়েকটি দেশে আমদানি করা হচ্ছে।
তবে মৌ-চাষিরা অভিযোগ করে বলেন, সরিষা ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার করায় মৌমাছি মারা পড়ছে। এতে মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে মান্দা উপজেলায় ৭ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হয়েছে। গত বছর এ উপজেলায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ করা হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। কৃষকদের পরামর্শ দেয়ায় এবার উপজেলায় ব্যাপক সরিষার আবাদ হয়েছে। বোরো ফসলের আবাদের জন্য যেসব জমি ফেলে রাখা হতো এবার সে সমস্ত জমিতেও সরিষার আবাদ করেছে কৃষক। সঠিক সময়ে পরামর্শ দেয়া কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন।
কৃষক ও মধু সংগ্রহকারী সূত্রে জানা গেছে, ফসলি জমিতে পোকা-মাকড় দমনের জন্য কৃষক ইচ্ছেমত কীটনাশক ব্যবহার করছেন। এছাড়া বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির প্রতিনিধিরা সরিষাসহ বিভিন্ন ফসলি আবাদি জমিতে কৃষকদের কীটনাশক ব্যবহার করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব কীটনাশক পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। বিশেষ করে মৌমাছিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মধু সংগ্রহকারীরা জানিয়েছেন, সরিষা ফুল থেকে নভেম্বর মাস থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত অর্থ্যাৎ ৪ মাস মধু সংগ্রহ করা যায়। বছরে মূলত মধু সংগ্রহ করা যায় ৮ মাস।
সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহের জন্য মান্দা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এসেছেন ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষিরা। এ সময় তারা তাদের ভ্রাম্যমাণ মৌচাষ প্রকল্পের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মধু সংগ্রহ করছেন।
নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলা থেকে আসা মধু সংগ্রহকারী আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১৫ বছর থেকে কৃত্রিমভাবে মধু সংগ্রহ করছেন। সপ্তাহ খানেক হলো মান্দায় এসেছেন। শ্রীরাম গ্রামের পাশে সরিষা খেতে ১০০টি মধু সংগ্রহের বাক্স রেখেছেন। এখনো মধু সংগ্রহ করেন নি। আবহাওয়া ভাল থাকলে ৭ দিনের মধ্যে মধু সংগ্রহের উপযোগী হয়। এক্ষেত্রে ১০০টি বাক্স থেকে প্রায় ২’শ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকলে ১৫-২০ দিনে মতো লাগতে পারে। তবে মৌমাছির আনাগোনা ভালো থাকায় এবার মধু সংগ্রহের পর খরচ বাদে ভাল লাভ থাকবে বলে জানান তিনি।
রাজশাহী মোহনপুর উপজেলায় থেকে আসা এমদাদুল হক বলেন, প্রায় ১০ বছর থেকে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে মধু সংগ্রহ করে আসছেন। ভারশোঁ গ্রামে প্রায় ২০ দিন থেকে মধু খামারে ৯৫টি বাক্স দিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। ৫-৭ দিন পর পর মধ্য সংগ্রহ করেন। এ পর্যন্ত সাড়ে ৪ মণের মতো মধু সংগ্রহ করেছেন। সরিষা ফুলের মধু ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫’শ টাকা মণ, লিচু ফুলের মধু ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা মণ। সব থেকে বেশি দাম কালাই জিরা ফুলের মধু। প্রতি মণ দাম ৭ হাজার টাকা মণ।
তিনি আরও বলেন, মধু সংগ্রহ বেশ কষ্টসাধ্য। সঠিক মূল্য না পাওয়ায় উৎপাদন হলেও পানির দরে বেঁচতে হয়। উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে মধু সংগ্রহ আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি।
শ্রীরামপুর গ্রামের সেফাতুল্লাহ বলেন, আগে গাছে গাছে মৌমাছির চাক থেকে মধু সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং ফসলি জমিতে ফুলে বিভিন্ন কীটনাশক প্রয়োগ করায় বড় মৌমাছিগুলো আর দেখা যায়। আগের মতো গাছে মৌমাছির চাক না থাকায় মধুর পরিমাণও কমে গেছে। তবে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মৌ-চাষিরা মধু সংগ্রহ করছেন। তিনি কৃষক ভাইদের অনুরোধ করেছেন ফুলে কীটনাশক প্রয়োগ না করার জন্য।
বালীচ গ্রামের কৃষক আলমগীর হোসনে বলেন, সরিষা আবাদে ফুল আসার আগে পোকা-মাকড় দমনের জন্য বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানির ওষুধ দেয়া হয়। গত দুই বছর থেকে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এছাড়া কীটনাশক কোম্পানির লোকজন কৃষকদের বিভিন্ন ওষুধ দেয়ার পরামর্শ দেন।
রাজশাহী সদর থেকে আসা রাম্মান আরিফিন রিমন বলেন, ২০০৬ সাল থেকে মধু সংগ্রহের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তিনি নিজস্বভাবে তৈরি উন্নত মানের প্রযুক্তিতে মধু সংগ্রহ করে থাকেন। এবার ২৫০টি বাক্সে মধু সংগ্রহ করছেন। বগুড়া, নওগাঁ, নাটোর, দিনাজপুর, ঈশ্বরদী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় সারা বছর মধু সংগ্রহ করে থাকেন।
তিনি আরও বলেন, গত বছর ভারতীয় ডাবর কোম্পানির বাংলাদেশ থেকে ৭ থেকে ৮শ’ টন মধু নিয়েছে। চলতি বছরেরও মধু নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়াও দেশীয় অল-ওয়েল কোম্পানি মধু সংগ্রহের ইউরোপনীয়ান ডেনমার্ক থেকে একটি উন্নত মানের মেশিন দেশে স্থাপন করেছে। তারাও মধু নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। অল-ওয়েল কোম্পনির মাধ্যমে ইউরোপে মধু রফতানি করার সম্ভাবনা রয়েছে।
মান্দা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম প্রামানিক বলেন, এবার উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে সরিষার আবাদ ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া নতুন জাতের সরিষার উদ্ভাবন করা হয়েছে। বারি-১৪ ও ১৫। এটি টরি-৭ থেকে অনেক উচ্চ ফলনশীল সরিষা এবং অধিক ফলন পেয়ে কৃষক লাভবান হচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক সত্যব্রত সাহা বলেন, মধু রফতানি হলে অনেক বেকারদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। এজন্য আগামীতে জেলায় সরিষা চাষ আরও বৃদ্ধি করা হয় কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও কৃষকদের ফুলে কীটনাশক প্রয়োগ না করার জন্য বলা হয়েছে। ক্ষেতে মৌমাছির আনাগোনা বেশি থাকলে পরাগায়ণে সুবিধা হয় এবং অধিক ফলন কৃষক পেতে পারে।
আব্বাস আলী/এসএস/এমএস