মিয়ানমারের ৩৭ কারখানার ইয়াবা ঢুকছে ২০ পয়েন্ট দিয়ে
কক্সবাজার ও বান্দরবানের ২৭২ কিলোমিটার সীমান্তের অন্তত ২০টি পয়েন্ট দিয়ে `বানের জলের' মতো দেশে ঢুকছে ইয়াবা। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমান্ত এলাকার ৩৭টি কারখানায় তৈরি ইয়াবা ‘পূঁজি ছাড়াই’ অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে বাংলাদেশে। এটি পাচারে রাতারাতি বড়লোক হবার ‘টোপে’ ব্যবহার হচ্ছে নিরীহ সব মানুষ। কৌশলে বাড়ানো হচ্ছে সেবনকারীও। চলতি বছরে প্রায় এক কোটি ইয়াবা জব্দ ও পাঁচ শতাধিক পাচারকারীকে গ্রেফতার করেছেন সীমান্ত রক্ষী ও বিভিন্ন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
প্রজন্ম ধ্বংসের লক্ষ্যে বৈশ্বিক চালে 'আধুনিক নেশা' ইয়াবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে বলে মনে করছেন বোদ্ধা মহল। শুধু জব্দ ও আটকে নয়, ইয়াবার আগ্রাসন কমাতে হলে উচ্চ মহল থেকে তৃণমূল সবখানেই আত্ম ও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন তারা।
ইয়াবার আগ্রাসন কমাতে, কঠোর অভিযানে 'বন্দুকযুদ্ধে' ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকশ মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। যদিও কিছু 'বন্দুকযুদ্ধ' ও নিহতের ঘটনা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এতসব কিছুর পরও কোনো অংশেই কমেনি ইয়াবা অনুপ্রবেশ ও দেশময় সরবরাহ।
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা হত্যাকেও মাদক উদ্ধার ঘটনার সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেষ্টা চালানোর ফন্দি প্রকাশ পাবার পর বলতে গেলে ইয়াবা প্রতিরোধে কমে গেছে কঠোরতা। ফলে করোনাকালেও রমরমা ইয়াবা অনুপ্রবেশ ও বিপণন। এতে, বাড়ছে মাদকসেবীদের সংখ্যা। যার সিংহভাগই যুবক।
এক পরিসংখ্যানে বলছে, চলমান সময়ে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ৮০ লাখের উপরে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশই ইয়াবাসেবী। অন্য যেকোনো মাদকের চেয়ে সহজলভ্যতা, সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। ইদানিং অনলাইনে ইয়াবা বেচা-কেনা ও হোম ডেলিভারিও মিলছে। তাই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ইয়াবাসেবীদের সংখ্যা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, চলতি বছরে জেলা পুলিশ অভিযান চালিয়ে একদিনে ১৭ লাখসহ এখন পর্যন্ত ৩৫ লাখের বেশি ইয়াবা উদ্ধার ও দুই শতাধিক কারবারিকে গ্রেফতার করেছে। অন্যদিকে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব-১৫) চলতি বছরে প্রায় ২২ লাখ ইয়াবাসহ ২৬৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। একইভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি জব্দ করেছে ২০ লাখ ইয়াবা।
এ ছাড়া কোস্টগার্ড ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এপিবিএন এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করে অন্তত ২০ লাখ ইয়াবা। সব মিলিয়ে বছরের এ পর্যন্ত প্রায় এক কোটি ইয়াবা জব্দ হয়েছে। যা রেকর্ড।
দেখা গেছে, কখনো পেটের ভেতর, সংবাদপত্র স্টিকারে গাড়িতে, কখনো ল্যাপটপ ও মোবাইল বক্সে, দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি বা গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতর ঢুকিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ হচ্ছে ইয়াবা। নারীরাও বিশেষ পদ্ধতিতে এসব পাচারে জড়িত। কিছু চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আটক করলেও বেশিরভাগই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। এভাবে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন কারবারি ও সহযোগীরা।
করোনায় মারা যাওয়ার পূর্বে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মোহাম্মদ শাহজাহান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইয়াবার আগ্রাসন বৈশ্বিক চাল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলমান আওয়ামী লীগ সরকারের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় বাংলাদেশ দ্রুত উন্নত দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। দেশে তৈরি হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি। প্রজন্ম দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি সবদিকে স্বনির্ভর হলে অনেক দেশের 'মোড়লপনা' বন্ধ হবে। তাই প্রজন্ম ধ্বংস ও উন্নয়ন রথ থামাতে কিছু দেশ মিয়ানমারকে হাত করে বাকিতেও বানের জলের মতো ইয়াবা ঢুকাচ্ছে।’
একই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীরা ইয়াবাসহ গ্রেফতারের ঘটনায় গণমাধ্যমে এসেছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে কোনো অপশক্তি আমাদের যুব সমাজকে ধ্বংস করতে মাদককে হাতিয়ার বানিয়ে ফায়দা লুটছে। এটি মাথায় রেখে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।’
কক্সবাজার ফিউচার লাইফ মাদক নিরাময় কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক জসিম উদ্দিন কাজল বলেন, ‘শুধু মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে মাদক নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। মাদক নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে সীমান্তে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার পাশাপাশি মাদকের চাহিদা হ্রাস করতে হবে। তরুণদের মাদকে না জড়াতে অভিভাবক পর্যায়ে ব্যাপক সচেতনতা বাড়ানো দরকার।’
টেকনাফ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খানের মতে, মাদক পাচার বন্ধ করতে হলে প্রথমত মূল নিয়ন্ত্রকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে সিন্ডিকেটগুলো। চলমান সময়ে মাদক পাচারে রোহিঙ্গারা একটা বড় সমস্যা। এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ অতি জরুরি। গত ৩ বছরের মাদকবিরোধী অভিযানে দেশীয় মাদক ব্যবসায়ী কমলেও রোহিঙ্গা কারবারি, পাচারকারী, বহনকারী বৃদ্ধি পেয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেল ফেরত কয়েকজন মাদক মামলার আসামি নিজেরা সংশোধন হয়ে গেছেন দাবি করে বলেন, চাহিদা থাকলেও করোনাকালে দূরপাল্লার পরিবহন বন্ধ থাকায় ইয়াবা বেচাবিক্রি কমে যায়। কিন্তু ব্যবসা চাঙ্গা রাখতে মিয়ানমারের কারবারিরা প্রথমে দাম কমিয়ে দেয় এবং পরে সহজ কিস্তিতে ইয়াবা পাঠায়।
এ সুযোগে দেশের কারবারিরা বিপুল পরিমাণ ইয়াবা মজুত করেছে জানিয়ে তারা বলছেন, যে পরিমাণ ইয়াবা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ঢুকছে তার ২০ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ছে।
ইয়াবার লেনদেনকে ঘিরে কারবারিদের মধ্যে মারামারি ও খুনাখুনির ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। চলতি বছর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে টেকনাফে তিনটি ও কক্সবাজার শহরের দু'টিসহ মোট পাঁচটি হত্যার ঘটনা ইয়াবার লেনদেনকে ঘিরে সংঘটিত হয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
এ ছাড়া সম্প্রতি মাদকের বাকি টাকা চাইতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন জেল ফেরত মাদক কারবারি উখিয়ার পালংখালীর আবদুর রশিদ। বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আনোয়ারুল ইসলাম জাবু নামের একজনকে প্রায় কোটি টাকার ইয়াবা দিয়েছিলাম। মাত্র ৬ লাখ টাকা দেয় সে। বাকি টাকা চাইতে গেলে আমার ওপর হামলা চালায়।’
অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত জাবু বলেন, ‘এটি আমার আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র।’
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ৬৮ জন নিহত হন। এর মধ্যে ৫১ জন রোহিঙ্গা ছিলেন। এতে ২৬ জন ছিলেন সক্রিয় ডাকাত। বাকিরা মাদক কারবারি। এর আগে ২০১৮ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযান ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় ৫৬ রোহিঙ্গাসহ ২০৯ জন নিহত হন। কক্সবাজার জেলায় মাদকবিরোধী অভিযানে এ পর্যন্ত ২৭৭ জন মারা গেছেন।
স্থানীয়দের মতে, টেকনাফের যেসব পয়েন্ট দিয়ে এখনও ইয়াবার চালান আসছে সেসব পয়েন্টগুলো হলো- শাহপরীর দ্বীপে ঘোলার চর, জালিয়াপাড়া, পশ্চিমপাড়া, ভাঙ্গারমুখ, সাবরাংয়ের খুরের মুখ, নয়াপাড়া, আছারবনিয়া, মগপাড়া, আলুগোলার তোড়া, সিকদার পাড়া, সদর ইউনিয়নের নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাইট্যংপাড়া, রাশিয়ান ফিশারি, তুলাতলী ঘাট, মহেশখালীপাড়া, লম্বরী ঘাট, হাবিরছড়া, রাজারছড়া, পৌরসভার কায়ুকখালীপাড়া, কেরুনতলী, হাঙ্গার ডেইল, ট্রানজিট জেটি, হ্নীলার দমদমিয়া, দক্ষিণ জাদিমোরা ওমর খাল, জাদির তলা, ব্রিটিশপাড়া, জাইল্যাঘাট, নয়াপাড়া, মোচনী, পূর্ব লেদা, বৃহত্তর আলীখালী, রঙ্গিখালী, চৌধুরীপাড়া, নাটমোরাপাড়া-জালিয়াপাড়া, জেলেপাড়া, পূর্ব ফুলের ডেইল, সুলিশপাড়া, হোয়াব্রাং, মৌলভী বাজার, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাংখালী, নয়াবাজার, মিনাবাজার-ঝিমংখালী, নয়াপাড়া, কাঞ্জরপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, ঊনছিপ্রাং, লম্বাবিল, হোয়াইক্যং পূর্বপাড়া, কোনারপাড়া, উখিয়ার বালুখালী, পালংখালী, খারাইগ্যাঘোনা, ঊলুবনিয়া কাটাখালী, বান্দরবানের ঘুমধুম, চাকঢালাসহ বেশ কয়েকটি স্থলপথ।
এসব পয়েন্টে নজরদারি বাড়িয়ে সীমন্তরক্ষী ও শৃঙ্খলা বাহিনী আসা-যাওয়া কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে এক পিস ইয়াবাও দেশে প্রবেশ অসম্ভব। যদিও নিজেদের কঠোর নজরদারির কারণে অধিকাংশ ইয়াবা চালান ধরা পড়ছে বলে দাবি করেছে সীমান্ত রক্ষী ও শৃঙ্খলা বাহিনী।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান বলেন, ‘দেশের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণই পুলিশের মূল কাজ। এরপরও মাদকের চালান জব্দে কঠোর ভূমিকা রাখছে পুলিশ। চলতি বছর সবচেয়ে বড় ইয়াবার চালান জব্দের কৃতিত্ব রয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের। এ ধারা অব্যাহত থাকবে।’
কক্সবাজার র্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘গ্রেফতার অনেক ইয়াবা কারবারি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, চালান আনতে কেউ মিয়ানমারে গেলে তাদের বাধার পরিবর্তে উল্টো সহযোগিতা করেন মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। এতে বোঝা যাচ্ছে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত। এ কারণে সহজে ইয়াবা আনতে পারে কারবারিরা। এটি চলমান থাকলে দেশে মাদক নির্মূল কঠিন হয়ে পড়বে।’
কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ আহমেদের মতে, ২০১৯ সালে বিজিবি ইয়াবা উদ্ধার কর ৫ লাখ। ২০২০ সালে উদ্ধার হয়েছে ২০ লাখ ইয়াবা। আর চলতি বছরের চলমান সময়ে ২০ লাখ ইয়াবা জব্দ করেছে বিজিবি। সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোয় এ সফলতা।
উল্লেখ্য, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় কক্সবাজার জেলার ১ হাজার ১৫১ ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম রয়েছে। ৫৪ জনকে গডফাদার (নেপথ্যের নায়ক) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাতজন ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। আত্মসমর্পণ করেছেন ২৩ জন। তারা কক্সবাজার কারাগারে ছিলেন।
অনেকে কারাগারে বসেই স্বজন এবং তাদের নিয়োজিত মাদক ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ব্যবসা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। অনেকে জামিনে এসে নিজে সাধু সেজে বাহক দিয়ে ব্যবসা সচল করেছেন। বাকি ২৪ জন গডফাদার বহাল তবিয়তে আছেন। তারা একরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের অনেকেই ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, ‘সরকারের উচিত অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে মাদকবিরোধী ‘মাস্টার প্ল্যান’ সাজানো। মূলত গডফাদারদের ধরতে না পারার ইয়াবার আগ্রাসন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
সায়ীদ আলমগীর/এসজে/জিকেএস