বয়স বাড়িয়ে আসামি, পিয়ারার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ২৬ বছর
দীর্ঘ ২৬ বছর কারাভোগের পর গত ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান পিয়ারা আক্তার (৩৮)। ১৯৯৭ সালের ২৪ এপ্রিল ১১ বছর বয়সে স্কুল থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তখন পিয়ারা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। এরপর পানিতে ডুবে চাচাতো বোনের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলায় তাকে আসামি করা হয়। মামলার এজাহারে তখন ১১ বছর বয়সী পিয়ারা বেগমের বয়স বাড়িয়ে ১৭ বছর উল্লেখ করা হয়।
অর্থের অভাবে পিয়ারা বেগমের পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী থাকলেও পিয়ারা আক্তারের মামলায় তার গুরুত্ব ছিল না। ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর এ হত্যা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। সেই থেকে কারাগারে যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছিলেন পিয়ারা আক্তার।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে যান বরিশাল জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার। সেখানে পিয়ারার মুখে জীবনের এমন করুণ কাহিনি শুনে জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের মনে দাগ কেটে যায়। ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সদাচরণকারী বন্দিদের একটি তালিকা বরিশাল কারা কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দারের সুপারিশে ওই তালিকায় পিয়ারা আক্তারের নাম ছিল। কারাবাসকালে সদাচরণের জন্য বিশেষ বিবেচনায় পিয়ারাসহ কয়েজন বন্দির মুক্তির আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মঞ্জুর করে। অবশেষে গত ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান পিয়ারা আক্তার।
পিয়ারা আক্তার পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার মৃত আনিস মৃধার মেয়ে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুন) বিকেলে জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় পিয়ারা বেগমের। তিনি বলেন, ‘তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমিই সবার ছোট। গ্রামে আমাদের কৃষিজমি ছিল। বাবা আনিস মৃধা নিজেদের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। জমির ফসল বিক্রি করে যা আয় হতো তা দিয়েই বেশ চলতো আমাদের সংসার। অভাব-অনটন ছিল না। পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান। এরপরই চাচা জিয়াউল হক আমাদের জমি দখলের চেষ্টা করেন। জমি দখলের জন্য আমাদের নানাভাবে হয়রানি শুরু করেন। আমার মা এক টুকরা জমিও জীবন থাকতে জিয়াউল হককে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। অন্যদিকে জমির জন্য আমাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন শুরু হয়।’
পিয়ারা বেগম বলেন, ‘এসব ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন আমার বয়স পাঁচ বছর। চাচা জিয়াউল হকের এসব ষড়যন্ত্র বোঝার বয়স ছিল না। পরে মা ও বড় ভাইয়ের কাছ থেকে এসব কথা জেনেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় পুলিশ পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে থাকা এক ব্যক্তি স্কুল থেকে আমাকে ধরে নিয়ে যান। থানায় নিয়ে আমাকে বলেন, তোমার চাচাতো বোন মেজবিনকে সাঁকো থেকে ফেলে দিয়েছ বলে আদালতে জবানবন্দি দেবে। তাহলে আমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। অন্যকথা বললে আমাকে জেলে দেয়া হবে বলে ভয় দেখানো হয়।’
পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘আমি ওই পুলিশ সদস্যের শিখিয়ে দেয়া কথামতো আদালতে জবানবন্দি দেই। আমাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। আমার পরিবারের সদস্যরা তখনও জানতেন না আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সাত মাস পর গ্রামের এক ব্যক্তির সঙ্গে কারাগারে দেখা হয়। এর কয়েক দিন আগে জমি নিয়ে মারামারির একটি মামলায় তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। ওই ব্যক্তি কারাগারে আমাকে জানান, আমাকে গ্রেফতারের কথা পরিবারের সদস্যরা কেউ জানে না। এমনকি গ্রামের লোকজনও নয়। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় আমাকে অনেক খোঁজ করেছে। কয়েক মাস কোথাও সন্ধান না পেয়ে তারা ভেবে নিয়েছে আমার মৃত্যু হয়েছে।’
পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘গ্রামের ওই ব্যক্তি জামিনে মুক্তি পেয়ে আমার মা ও ভাইকে বিষয়টি জানান। এরপর একদিন ভাই এসে কারাগারে আমার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর আমার ভাই মামলার কাগজপত্র তুলে দেখতে পান, চাচাতো বোন মেজবিন পানিতে ডুবে মারা গেলেও ওই ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। ওই মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমার বয়স ১১ থেকে বাড়িয়ে মামলার এজাহারে ১৭ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ভাই নানাভাবে চেষ্টা করেছেন থানা পুলিশকে বিষয়টি জানাতে। তখন আমার ভাইয়ের বয়সও বেশি ছিল না। তার কথা কেউ শোনেনি। অর্থের অভাবে আমার পক্ষে আইনজীবী দেয়ার আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি আমার মামলায় কখনো গুরুত্ব দেননি। ১৯৯৮ সালের ১১ নভেম্বর এ হত্যা মামলার রায়ে পিরোজপুরের একটি আদালত আমাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। এরপর পিরোজপুর থেকে বরিশাল কারাগারে আমাকে স্থানান্তর করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘গত ফেব্রুয়ারি মাসে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনে আসেন জেলা প্রশাসক স্যার। আমার এ ঘটনা তাকে খুলে বলি। তিনি আইনি সহায়তার আশ্বাস দেন। তার প্রচেষ্টায় গত ১০ জুন বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আমি মুক্তি পাই। তিনি আমাকে ফোন দিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দেখা করতে বলেন। সেখানে উপস্থিত হলে আমাকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির নিয়োগপত্র ও সেলাই মেশিন দেন।’
পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘জেলা প্রশাসক স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। আমার মতো এক অসহায় নারীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন বলেই মুক্তি পেয়েছি। তার সহায়তায় চাকরিও পেয়েছি। দোয়া করি আল্লাহ স্যারকে ভালো রাখুন।’
পিয়ারা আক্তারের ভাই ইউনুস মৃধা বলেন, ‘আমরা ধরেই নিয়েছিলাম পিয়ারা জীবিত নেই। নিখোঁজের সাত মাস কারাগারে পিয়ারার সন্ধান পাই। এরপর মামলার কাগজপত্র তুলে দেখি আমার চাচা জিয়াউল হক বাদী হয়ে পিয়ারার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। তখন পুলিশের কাছে বোনের মুক্তির জন্য অনেক মিনতি করেছি। তবে কাজ হয়নি। বিষয়টি জানার পর চাচা জিয়াউল হক আমাকেও মামলায় ফাঁসিয়ে জেলে পাঠানোর চেষ্টা করেন। এলাকাছাড়া করতে তখন আমাকে নানাভাবে হুমকি দেন। তাছাড়া আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় বোনের মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারিনি।
অন্যদিকে চাচা জিয়াউল হক অর্থ ও প্রভাবের কাছে আমাদের পরিবার ছিল অনেকটা অসহায়। আত্মীয়স্বজনসহ এলাকার কেউ এগিয়ে আসেনি বা সহায়তা করেনি।’
ইউনুস মৃধা বলেন, ‘তার বোনের জীবন থেকে দীর্ঘ ২৬ বছর হারিয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ চান তারা। পাশাপাশি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।’
এদিকে বৃহস্পতিবার পিয়ারা আক্তারের মতো আরও তিনজন জেলা প্রশাসকের সহায়তায় পেয়েছেন নতুন জীবনের সন্ধান। সম্প্রতি তারা কারামুক্তি পেয়ে জীবন-জীবিকা নিয়ে হতাশার মধ্যে ছিলেন।
বরিশালের হিজলা উপজেলার ৬৪ বছরের বৃদ্ধ ভ্যানচালক আব্দুর রহমান মাঝি চুরি মামলায় এক বছর কারাভোগের পর সম্প্রতি মুক্তি পান। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তিনিও পড়েছিলেন হতাশার মধ্যে। জেলা প্রশাসক তাকে একটি ভ্যান উপহার দিয়েছেন।
একই উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের ৩৩ বছর বয়সী গৃহবধূ খালেদা আক্তার স্বামী হত্যা মামলায় চার বছর কারাভোগ করে সম্প্রতি জামিনে মুক্ত হন।
খালেদা আক্তার জানান, তিনি চট্টগ্রামের মেয়ে। প্রায় এক যুগ আগে শহিদ মোল্লা নামের একজনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এতে খুশি ছিল না শ্বশুরবাড়ির লোকজন। বিয়ের পর কারণে অকারণে শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন। ২০১৮ সালে তার স্বামীকে সর্বহারা নামধারী সন্ত্রাসীরা খুন করে। কিন্তু ওই ঘটনায় শশুরবাড়ির লোকজন তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেন। চার বছর পর মুক্তি পেয়ে তিন সন্তান নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছিলেন তিনি। একটি কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েছেন। হত্যা মামলার আসামি হওয়ার কারণে কেউ তাকে কাজে নেননি। কারাগারে সেলাই মেশিন দিয়ে জামা-কাপড় বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন খালেদা আক্তার।
খালেদা আক্তার বলেন, ‘একটি সেলাই মেশিন কেনার সাধ্য ছিল না। জেলা প্রশাসক স্যারের কাছ থেকে একটি সেলাই মেশিন উপহার পেয়েছি। এখন জামা-কাপড় তৈরির আয় দিয়ে সন্তানদের দু’বেলা খাবার জোটানো সম্ভব হবে।’
অন্যদিকে মাদক মামলায় তিন বছর কারাভোগ করে এক মাস আগে মুক্তি পাওয়া বরিশাল নগরীর পলাশপুর এলাকার আয়েশা আক্তারও (৩৩) উপহার পেয়েছেন একটি সেলাই মেশিন। মাদক ব্যবসা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা করেছেন আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘যত কষ্টই হোক আর অসৎ পথে উপার্জনের চেষ্টা করবো না।’
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দীন হায়দার জানান, পিয়ারা বেগমের ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়েছে। তার জীবনের কারাভোগের দীর্ঘ ২৬ বছর ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। তার ভবিষ্যৎ জীবনের কথা বিবেচনা করে তাকে চাকরি দেয়ার পাশাপাশি একটি সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। পিয়ারা বেগমের মতো আরও তিনজনকে ভ্যান ও সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। এসব উপহার তুলে দেয়ার সময় তাদের মুখের হাসি আমাকে মুগ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। সর্বোপরি দীর্ঘদিন কারাভোগ করে ফেরা চারজনের পরিবারের কিছুটা হলেও দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। স্বাভাবিক জীবন যাপনে টিকে থাকতে তাদের দেয়া উপহার আশা করি কাজে লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার উদ্যোগে এবং কারাগারের অভ্যন্তরে অপরাধী সংশোধন ও পুনর্বাসন সমিতি, সমাজসেবা অধিদফতর এবং বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার কর্তৃপক্ষের সহায়তায় সদ্য কারামুক্ত হওয়া চারজনকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
সাইফ আমীন/ইএ