নেত্রকোনা হাসপাতালে জনবল সঙ্কট, করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম
নেত্রকোনায় ফের বাড়তে শুরু করেছে করোনা সংক্রমণ। সীমান্তের দুই উপজেলা দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার চারটি ইউনিয়নে প্রতিদিন শত শত করোনার লক্ষণ নিয়ে রোগীরা আসছেন হাসপাতালে। সর্দি, জ্বর, কাশি ও গলা ব্যথার রোগীরা ভিড় করছে চিকিৎসা কেন্দ্রে।
এ পরিস্থিতিতেও নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালে চালু হয়নি সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থার। নেই কোনো ভেন্টিলেটর। নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) বেডও।
হাসপাতালটিতে রয়েছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্কট। জরুরি চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য এসব ব্যবস্থা না থাকায় চলমান পরিস্থিতিতে জেলাবাসীর মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সঙ্কটময় মুহূর্তে হাসপাতালটি নিজেই যেন ভুগছে নানান সমস্যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতালটি জেলা সদরের একমাত্র সরকারি হাসপাতাল। জেলা সদর ছাড়াও ৯ উপজেলার রোগীরা জরুরি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য এ হাসপাতালটির ওপর নির্ভর করেন। এরইমধ্যে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও এখনও এর কার্যক্রম চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই।
গতবছর করোনা পরিস্থিতির শুরুতে হাসপাতালটিতে ৩৬টি শয্যা নিয়ে চালু করা হয় করোনা ওয়ার্ড। কিন্তু কেবল ৩৬টি শয্যা, তিনটি পালস অক্সিমিটার আর ১১টি অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ছাড়া আর কিছুই যেন নেই করোনা ইউনিটে। শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য অক্সিজেন সহায়তা অপরিহার্য হলেও পুরো হাসপাতালে আজও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। গণপূর্ত বিভাগ সেন্ট্রাল অক্সিজেন চালুর জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন করছে। তবে এখনো শেষ হয়নি এর কাজ।
সম্প্রতি হাসপাতালটির জন্য দুটি ভেন্টিলেটর মেশিন সরবরাহ করা হলেও অ্যানেসথেসিস্ট ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেনের অভাবে সেগুলোও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। পুরো হাসপাতালে একটিও আইসিইউ বেড নেই। হাই-ফ্লো ন্যাজাল কেনুলারও অভাব রয়েছে।
পুরো হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা চলছে মাত্র একটি অ্যাম্বুলেন্স দিয়ে। রোগীর চাপ বেশি থাকায় বেশিরভাগ সময় প্রাইভেট অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনতে হয়। হাসপাতালটিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরও সঙ্কট রয়েছে। উপজেলা হাসপাতালগুলো থেকে কর্মচারীদের এনে চাপ সামলানো হচ্ছে।
নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ৯টি সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ এবং আটটি জুনিয়র কনসালটেন্টের পদ শূন্য রয়েছে। সিনিয়র কনসালটেন্টের মধ্যে কার্ডিওলজি, মেডিসিন, চক্ষু, ইএনটি, শিশু, প্যাথলজি, গাইনী, অ্যানেসথেসিয়া এবং অর্থোপেডিক্সের পদ শূন্য। অ্যানেসথেসিস্ট না থাকায় সব ধরনের অপারেশনের কাজও বন্ধ বলে জানা গেছে। অনেক সময় বাইরে থেকে অ্যানেসথেসিস্ট এনে অপারেশনের কাজ করানো হয়।
জুনিয়র কনসালটেন্ট পদের মধ্যে রয়েছে- প্যাথলজি, ইএনটি, চক্ষু, শিশু, চর্ম ও যৌন, মেডিসিন, সার্জারি এবং রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং চিকিৎসক। এছাড়া মেডিকেল কর্মকর্তার একজন, সমমানের সহকারী সার্জন সাতজন, প্যাথলজিস্ট একজন, ডেন্টাল সার্জন একজন এবং একজন হোমিও মেডিকেল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে।
অপরদিকে, তৃতীয় শ্রেণির ৫৪টি পদের মধ্যে ২৯টি পদ শূন্য থাকায় হাসপাতালের স্বাভাবিক কাজ কর্মের সমস্যা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় স্বাভাবিক রোগীদের ময়মনসিংহ অথবা ঢাকায় রেফার করা হচ্ছে।
করোনা রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও নাজুক। বর্তমানে চারজন করোনা রোগী হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। করোনা রোগীদের জন্য ৩৬টি বেড রয়েছে। করোনার আশঙ্কাজনক রোগী হাসপাতালে গেলেই সমস্যায় পড়তে হবে কর্তৃপক্ষের।
সিভিল সার্জন অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার নেত্রকোনায় ১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। জেলায় মোট রোগী ১ হাজার ২৮৪ জনের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ১০৭ জন। মারা গেছেন ২৫ জন।
র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করতে গেলে অতিরিক্ত টাকা না দিলে নমুনা না নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে সদর হাসপাতালের ল্যাবে কর্মরতদের বিরুদ্ধে। এছাড়া নমুনা দেয়ার পর রিপোর্ট প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও পোহাতে হয় বিড়ম্বনা।
দুর্গাপুর সীমান্তের বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্প ইনচার্জ হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘সীমান্তে অবৈধ চলাচলের বিষয়ে আমরা শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে রয়েছি। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যটক বা কোনো প্রকার চোরা-কারবারি আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আসা-যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
দুর্গাপুর উপজেলা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা তানজিরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিদিন শতাধিক মানুষ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসছেন জ্বর, সর্দি-কাশি ও গলা ব্যথা নিয়ে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর। আমাদের মেডিকেল অফিসাররা ২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা চালু রেখেছেন। রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাপত্র দিয়ে নিজ নিজ বাড়িতেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবস্থান করতে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।’
তবে সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এএসএম মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করতে আরও সময় লাগবে। ভেন্টিলেটর দুটো চালু করতেও কমপক্ষে তিনজন অ্যানেসথেটিস্ট এবং অন্তত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজন। চলতি মাসের মধ্যে সেন্ট্রাল অক্সিজেন স্থাপনের কাজ শেষ হবে।’
সিভিল সার্জন ডা. সেলিম মিঞা বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য সব প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। তবে জটিল রোগী হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনা রোগীদের পরিবহনের জন্য আমরা আরেকটি বিকল্প অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করছি। এছাড়া সব ধরনের সরঞ্জাম চেয়ে বিভাগীয় পরিচালকের কাছে চাহিদাপত্র পাঠিয়েছি।’
আক্রান্ত রোগীদের ভারতীয় ধরন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এর জন্য ঢাকায় যোগাযোগ করা হয়েছে।’
নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মো. আবদুর রহমান বলেন, ‘জেলা প্রশাসনে জরুরি ভিত্তিতে ভার্চুয়াল সভা ডাকা হয়েছে। সভার সিদ্ধান্ত হয়েছে চার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে লকডাউন দেয়ার। অতিরিক্ত আক্রান্ত ইউনিয়নগুলোতে গিয়ে ভ্রাম্যমাণ নমুনা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অন্যান্য সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
এইচ এম কামাল/এসজে/এএসএম